শনিবার, ৪ মে ২০২৪ | ২০ বৈশাখ ১৪৩১
Dhaka Prokash

ড. মিল্টন বিশ্বাস

মোস্তফা কামালের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের উপন্যাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়েছেন, চিত্রিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ। যার ফলে তার উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ মিলেমিশে একাকার হয়েছে, উঠে এসেছে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক ‘অগ্নিকন্যা’ (২০১৭), ‘অগ্নিপুরুষ’ (২০১৮) ও ‘অগ্নিমানুষ’ (২০১৯) তাঁর অন্যতম সৃষ্টি। উপন্যাসগুলোর কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে ইতিহাস ও শিল্প পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ইতিহাসের কঙ্কালের ওপর কল্পনার অস্থিমজ্জা মিশিয়ে লেখক সৃষ্টি করেছেন সফল একেকটি সাহিত্যকর্ম। লেখকের কল্পনায় ইতিহাসের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনা ও চরিত্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি পেয়েছে প্রত্যাশিত গতি। এসব উপন্যাসের ভেতরে আছে রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সমাজসংলগ্ন মানুষের অধিকারের কথা; ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, শ্রেণি বৈষম্য, ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাত, বিপর্যয়, রাজনৈতিক নানা অস্থিরতা ও সমকালীন নানা প্রসঙ্গ আখ্যানে স্থান পেয়েছে।

 

মোস্তফা কামালের উপন্যাসত্রয়ীর সময় হচ্ছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, দেশভাগ থেকে স্বাধীনতা। সেই সময় এবং ইতিহাস নির্মাতাদের নিয়ে লেখা ট্রিলজি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়াও আছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান। আরও আছেন খাজা নাজিম উদ্দিন, গোলাম মোহাম্মদ, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান প্রমুখ। উপন্যাসে বর্ণিত সময়ের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপিত হয়েছে লেখকের বয়ানে। প্রতিটি ঐতিহাসিক চরিত্রকে তিনি নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন। তাদের জীবন-যাপন, তাদের আচরণ, তাদের কথা বলার ধরন কেমন ছিল, তাও ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রগুলো সত্য হওয়ায় সেগুলোকে নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে তিনি সতর্ক ছিলেন। সঠিক তথ্যের জন্য বারবার তাঁকে যাচাই-বাছাই করতে হয়েছে যদিও তিনি ইতিহাস লিখতে বসেননি। তবে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ও চরিত্রগুলো নিয়ে লেখা উপন্যাসের আখ্যান নির্মিতি কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটাকে সহজভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরার কৌশলটাই তাঁকে রপ্ত করতে হয়েছে।

‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসে ১৯৪৭ থেকে ছেষট্টি সালের রাজনৈতিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। যে কালকে তিনি অগ্নিকন্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যে সময় রাজনীতি পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাদের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও বাঙালির প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। এই প্রতিবাদ রূপায়ণ করার জন্য লেখক ইতিহাসের নায়কদের হাজির করেছেন আখ্যানের ভেতর। আবার সেই ইতিহাসের নায়কদের সামাজিক মানুষ করে তোলার কৃতিত্বও তাঁর।

‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসে উপস্থাপিত ঘটনাবলি ইতিহাসের উপকরণ। অবশ্য ইতিহাসের ঘটনার সত্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। বঙ্গবন্ধুর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ঘটনাক্রমকে অনুপুঙ্খভাবে রূপায়ণ করেছেন ঔপন্যাসিক। এসব ক্ষেত্রে জাতির পিতার সঙ্গে অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রকে পূর্ণাঙ্গভাবে চিত্রায়ণের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ মোস্তফা কামাল ইতিহাসের একটি সময়কে পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়ে সেই সময়ের মানুষকে চিত্রিত করেছেন। অনেকেই ইতিহাসের পটভূমিতে নির্মিত গল্প-কাঠামোর মানুষের ভেতর দিয়ে বর্তমানের আকাঙ্ক্ষা ও মননকে চিত্রিত করেন। ঐতিহাসিক সময় ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খতা ভেঙে বের হয়ে আসে। বাংলা সাহিত্যে লিখিত ইতিহাসের অবিকৃত সময়কে নিয়েও উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা রয়েছে।

মূলত ইতিহাসের ঘটনাকে আশ্রয় করে ‘অগ্নিকন্যা’উপন্যাস রচিত হওয়ায় একটি কালের সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। আবার সেখানে রাজনীতি সম্পৃক্ততায় নেতা এবং জনগণ উপস্থাপিত হয়েছে। তবে মোস্তফা কামাল একটি কালপর্বের সামগ্রিক বিষয়কে তুলে ধরেছেন, যার ভেতর নতুনত্ব আছে। বিশেষত তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উপকরণ নিয়ে ঘটনা সাজিয়েছেন কিন্তু সেখানে শেখ মুজিবকে আমরা নতুন করে খুঁজে পাই। দেখতে পাই পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র আর বাঙালি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের ভেতর তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হচ্ছেন নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও তৃণমূল-সংলগ্নতায়।

অন্যদিকে এ উপন্যাসের সূচনায় মতিয়া চৌধুরীর বাল্যকাল দিয়ে শুরু হয়েছে এবং ১৯৬৬ সালে যখন কাহিনির গতি পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে তখন তাকে আমরা রাজপথের সক্রিয় কর্মী হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। এই চরিত্রটিকে সামাজিক করে তোলার পুরো কৃতিত্ব মোস্তফা কামালের। কারণ পুলিশ অফিসারের কন্যা মতিয়া বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ায় পাকিস্তানি শাসকরা উদ্বিগ্ন হয়। সংকট তৈরি হয় মহিউদ্দিন-নূরজাহান বেগমের সংসারে। কিন্তু হঠাৎ সাংবাদিক বজলুর রহমানকে বিবাহ করে চমকে দেন মতিয়া। স্বামী প্রকৃত অভিভাবক হওয়ায় দমে যায় শাসকগোষ্ঠী। অর্থাৎ নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে কাহিনির ভিন্ন ভিন্ন গতিমুখ নির্দেশ করেছেন ঔপন্যাসিক।

‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসে ইতিহাসের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ইতিহাসকে উপজীব্য করায় উপন্যাসে সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য সকল নেতাকে কাহিনির ভেতর সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু যেমন তেমনি জিন্নাহ থেকে শুরু করে বাঙালির শত্রু সকল পাকিস্তানি চরিত্র আখ্যানে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মিডিয়ার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তারও বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে এই উপন্যাসে আবার ইতিহাসের কাহিনি ও চরিত্রকে অবলম্বন করা হয়েছে বলেই অতীতচারী কল্পনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাস দুটিতেও ইতিহাস ও রাজনীতির প্রসঙ্গ আছে। মোস্তফা কামাল অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে উপন্যাসের মূল চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উপস্থাপন করেছেন। যদিও চরিত্রটি বিনির্মাণে ঔপন্যাসিকের ঝুঁকি ছিল। কারণ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে ইতিহাস ও পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে উপন্যাস্ত করা মোটেও সহজ ছিল না। ইতিহাসের মূল চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রেখে চরিত্রগুলোকে যথাযথ ভূমিকায় উপস্থাপন করা কঠিন কাজ ছিল। সতর্কতার সঙ্গে সেই কাজটি করেছেন লেখক।

বাঙালির ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন। এটি ছিল বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে এক বিরাট মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল রচনা করেছেন ‘অগ্নিপুরুষ’। ৬৬র ৬ দফা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন এবং রূপান্তরিত হন ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসে সেই কথাই বিধৃত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু চরিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে ইতিহাস ও রাজনীতির চমৎকার মেলবন্ধন তৈরি করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, সমাজনীতি সর্বোপরি তাঁর জীবনকাঠামোকে ইতিহাসের আলোকে তুলে ধরেছেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনই এই উপন্যাস। ইতিহাসের যথাযথ রূপায়ণের কারণে ঔপন্যাসিক কোনো তথ্য বাদ দেননি বা অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করেননি। সেক্ষেত্রে তিনি ইতিহাসের পথ ধরেই হেঁটেছেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে এক আবেগের নাম। আর আবেগ দিয়ে কোনো ইতিহাসকে অতিরঞ্জিত করার সুযোগ থাকে, কিন্তু এই ঔপন্যাসিক সে পথে হাঁটেননি। তিনি ইতিহাসের বয়ান করে গেছেন ইতিহাসের আলোকে।

ট্রিলজির শেষপর্ব ‘অগ্নিমানুষ’উপন্যাস। ১৯৬৯ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এর আখ্যান বিস্তৃত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়টা খুব লম্বা না হলেও বাঙালি জাতির জন্য তা ছিল ঘটনাবহুল। বাঙালি মুসলমান এদেশে দীর্ঘদিন আত্মপরিচয়ের সংকটে ছিল। শাসকের দৃষ্টিতে তারা না ছিল বাঙালি না ছিল মুসলমান। সাতচল্লিশের ধর্মভিত্তিক দেশভাগে বাঙালি মুসলমান আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদায় নিজের মাটিতে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর হলো। কিন্তু অচিরেই তারা তাদের স্বপ্নভঙ্গের বার্তা শুনতে পেল। বিজাতীয় পাকিস্তানিরা ধর্মের ছদ্মবেশ ধারণ করে বাঙালির চেতনা মূলে আঘাত হানল। ফলে বাঙালির ধর্মপরিচয় ঊর্ধ্বে রেখে জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে রুখে দাঁড়াল। ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল এই সময় বাঙালির জাগরণ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নেতৃত্বের বিষয়টিকে চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন, যার কেন্দ্রে আছেন বঙ্গবন্ধু।

মূলত ত্রয়ী উপন্যাসে মোস্তফা কামাল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্তর্লোকে উঁকি দিয়ে একটি বিশেষ যুগ- বিশেষত দেশভাগের পর থেকে উত্তাল ঘটনার দিকে মনোযোগী হয়েছেন। মুখ্য চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে অন্য ব্যক্তিত্বের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশার প্রতিফলন ঘটেছে লেখকের নিজের অভিব্যক্তিতে। অবশ্য লেখক অতীতের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার-সংস্কার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সকল বিষয়ে সচেতন ছিলেন। আবার তাঁকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা প্রকাশে নির্লিপ্ত থাকতে হয়েছে।

 

মোস্তফা কামাল সৃজিত আখ্যানের প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক জীব। আর এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিককে সাধারণ মানুষ থেকে বেশি রাজনীতি সচেতন হতে হয়েছে। মূলত ইতিহাস তো ইতিহাস; পাশাপাশি উপন্যাস তো উপন্যাসই। দুয়ের উপাদানগত পার্থক্য অনেক। এ দুটি বিষয়ের মূল উপাদান সময় ও চরিত্র। একইসঙ্গে মূল ইতিহাসকে অক্ষুণ্ন রেখে এবং এর চরিত্রগুলোকে যথাযথ ভূমিকায় উপস্থাপন করা মোটেই সহজ কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটিই সহজ করে করতে দেখা যায় মোস্তফা কামালের ট্রিলজি ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপায়ণে। এই উপন্যাস ত্রয়ীতে ইতিহাস আশ্রিত চরিত্রগুলোকে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত করার জন্য একটি জীবনভাবনা বা বার্তা প্রদান করেছেন তিনি।

বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও লড়াই কেবল পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিল না, তা ছিল নিজেদের ভেতরও। এ কারণে লেখককে ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে আবর্তিত বিভিন্ন চরিত্রের জীবনের উত্থান ও পতন ব্যক্ত করার জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আবেগ-আলোড়ন তুলে ধরতে হয়েছে। কাহিনি ও চরিত্রকে মানবিক করে তোলার জন্য যা অবশ্যস্বীকার্য একটি বিষয়। উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি চরিত্রের আবরণ খুলে মহাকালের অঙ্গীভূত হয়ে উঠেছেন। স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বজনীন ব্যঞ্জনায় এর উপসংহার উপস্থাপিত।

লেখক বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনের প্রতিটি ক্ষণ উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে ঘটনা নির্মাণ করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম, সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং তাঁর পাহাড়সমান ব্যক্তিত্ব ও উদারতাকে মহিমান্বিত করেছেন। তিনি এমন একজন বাঙালি, যাঁর সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। একজন ক্ষণজন্মা মানুষ, এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁকে তিনি হৃদয়ে এবং চেতনায় ধারণ করেছেন বলেই উপন্যাসে তাঁর চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসটি ‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব। ‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাস যেখানে শেষ হয়েছিল ঠিক তারপর থেকে ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসটি শুরু হয়েছে। ‘অগ্নিকন্যা’ শেষ হয়েছিল বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ‘অগ্নিকন্যা’-এরর মূল চরিত্র মতিয়া চৌধুরী হলেও ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বঙ্গবন্ধু। মূলত উত্তাল সময়ের কথা নিয়ে লেখক হাজির হয়েছেন। সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দাবি যাঁর হাত দিয়ে বের হয়েছে তাঁর কথা বললে তো বঙ্গবন্ধুই প্রধান চরিত্র দাঁড়িয়ে যান। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যেমন বঙ্গবন্ধু এবং প্রধান সহযোগীগণ যেমন মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, শেখ মণি প্রমুখের অবদান উঠে এসেছে। ঠিক এদের বিপরীত চরিত্রও আছে উপন্যাসে। ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, জেনারেল মুসা খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো চরিত্রের উপস্থিতি ও ভূমিকা, তাদের ষড়যন্ত্র উপন্যাসজুড়ে ফুটে উঠেছে।

‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসের একেবারে কেন্দ্রে আছেন বঙ্গবন্ধু। মূলত বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনের সমান্তরাল চিত্র এঁকে গেছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় ছয় দফা ঘোষণার পর করাচি থেকে দেশের মাটিতে পা রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পাশে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দেখে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। এদিকে ছয় দফা দেখেই কুখ্যাত আইয়ুব খান নিজের পরিণতি আঁচ করতে পারেন। আইয়ুব খান তখন নানা ধরনের কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে থাকেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু জনগণের চাপে জেলের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য জোরালো আন্দোলন করতে থাকেন।

অপরদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানের চেষ্টা চালিয়ে যান আইয়ুব খান। ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে বললেন, শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারলেই সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। (পৃ ২১৫) কিন্তু পূর্ব বাংলার জনতা পাকিস্তানের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র মেনে নিতে পারেনি। তারা জোরালো প্রতিবাদ করতে থাকেন। জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। জনগণের এই তীব্র প্রতিবাদের কাছে হার মানে পাকিস্তানি শাসকরা। পশ্চিম পাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু মহানায়কের বেশে জেল থেকে ফিরে আসেন। তাই তো বঙ্গবন্ধুকে অগ্নিপুরুষ বলাটাই যথার্থ।

একইভাবে ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্গবন্ধু। মোস্তফা কামাল রচিত তিন পর্বের উপন্যাসের শেষ পর্ব। এর আগের দুটি উপন্যাস যথাক্রমে ‘অগ্নিকন্যা’ ও ‘অগ্নিপুরুষ’। ১৯৪৭ সাল যতটা স্বাধীনতা হিসেবে পরিচিতি পায় তার চেয়ে বেশি পেয়ে থাকে দেশভাগ হিসেবে। কেননা প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ এই ১৯৪৭ দিতে পারেনি। দেশত্যাগের সময় ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক দিক থেকে অনেক ভিন্ন ও দূরের ভূখণ্ডের সঙ্গে এক করে দেয়া হয় বাংলা অঞ্চলকে। অদূরদর্শিতা এবং অবিবেচনাপ্রসূত ছিল এই ঘটনা। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক এটা বুঝতে অপারগ ছিল। অবশ্য অনেকের মতো সেই বিভীষিকাময় অবস্থা মেনে নিতে পারেননি তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। এ জন্য দেশের জন্য তাঁর ত্যাগের মাধ্যমে তিনি মহান হয়েছেন। দূরদর্শিতার মাধ্যমে তিনি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ তৈরি করেছেন।

ছয় দফা আন্দোলনের পরবর্তী সময় অর্থাৎ ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতাগ্রহণের কাল থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর কারামুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়টুকু ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। কাহিনিতে গতিময়তা আনার জন্য ছোট ছোট শাখা-কাহিনি বঙ্গবন্ধুর আশপাশের বিভিন্ন চরিত্র, পাকিস্তানি খলচরিত্র- বলতে গেলে সবই বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মোস্তফা কামাল বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রে রেখেই উপন্যাসটি পরিকল্পনা মাফিক রচনা করেছেন। ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসে দুটি পক্ষকে সমান্তরালভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। এর একদিকে আছেন তরুণ থেকে পরিণত হতে থাকা শেখ মুজিব আর তাঁর সহযাত্রীরা অন্যদিকে রয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক শাসকগোষ্ঠী। একপক্ষ স্বাধীনতা, স্বাধিকার আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চায় অন্যপক্ষ কঠোর হস্তে তা দমন করতে বদ্ধপরিকর। দুই পক্ষের এ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেসব জটিল কর্মকাণ্ড উপন্যাসের মোড়কে উপস্থাপন করেছেন ঔপন্যাসিক। এদিক থেকে উপন্যাসটি ঐতিহাসিক। কিন্তু এখানে সময় ও চরিত্র দুটিই বাস্তবতার নিরিখে সৃষ্টি। ফলে কাজটি কিন্তু কঠিন। আর এই কঠিন কাজটি খুব সহজভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের পর যখন আইয়ুব খানের পতন হলো ক্ষমতায় এলেন ইয়াহিয়া খান তখন থেকে অগ্নিমানুষ উপন্যাসের কাঠামো অগ্রসর হওয়া শুরু করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছয় দফা ঘিরেই পাকিস্তানের রাজনীতি আবর্তিত হয়।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমানুষ রূপে আবির্ভূত হওয়ার ঘটনাকে ইতিহাসের নিকট দায়বদ্ধ থেকে তুলে ধরেছেন লেখক। তাঁর হাত ধরে আসে স্বাধীনতা। যদিও পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্বে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দি ছিলেন তবুও তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এই উপন্যাস। মূলত বঙ্গবন্ধুর একাগ্রতা ছিল; স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি অনেক বেশি স্পর্শকাতর ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মাঝে আপন পরিবার বাবা-মা-স্ত্রী, ছোট ছোট আদরের ছেলেমেয়েদের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা উপস্থাপিত হয়েছে এই উপন্যাসে। এই উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু একজন স্বপ্নপুরুষ। একজন দেশপ্রেমিক তরুণ যাঁর চোখে স্বাধীনতার লাল সূর্য জ্বল জ্বল করছে। তিনি একজন সাধারণ মানুষ যাঁর মা-বাবার জন্য প্রাণ কাঁদে; একজন আদর্শ স্বামী যিনি তাঁর স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে আগ্রহী, আদর্শ পিতা। কিন্তু স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে গিয়ে পরিবার-পরিজন থেকে পরস্পর বিছিন্ন থেকেছেন বহু বছর। এভাবে ইতিহাসের উপকরণকে সামাজিক জীবনের স্রোতরেখায় কাহিনিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন মোস্তফা কামাল।

 

উপন্যাসে বা আখ্যানে একটি নির্দিষ্ট সময়পর্বে উপস্থাপিত চরিত্রগুলো লেখককে নির্মাণ করতে হয়। আখ্যান বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রগুলোরও বিকাশ ঘটা স্বাভাবিক। ফলে চরিত্রগুলো একটা স্বতন্ত্র অবয়ব নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়। লেখক যদি চরিত্র বা চরিত্রগুলোর স্বতন্ত্র অবয়ব দিতে না পারেন, তাহলে তিনি ব্যর্থ। আখ্যান বা উপাখ্যানে যে চরিত্রগুলো লেখক ভাষার তুলিতে আঁকতে চান, সেই মানুষগুলো সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা, গভীর উপলব্ধি ও কল্পনাশক্তি না থাকলে, তাদের অবয়ব দেয়া সম্ভব হয় না। ত্রয়ী উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে এর সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’, ‘অগ্নিমানুষ’ ট্রিলজিতে মোস্তফা কামালের প্রধান চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। ঔপন্যাসিক ইতিহাসের সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধু চরিত্রটিকে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে নির্মাণ করেছেন। পরিবার ও ব্যক্তিজীবনকে তুচ্ছ করে জাতিরাষ্ট্রের জন্য জীবন বাজি রেখে লড়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগ্নিপুরুষে দেখা যায় তিনি মেয়ের বিয়ের সময় ছিলেন কারাবন্দি অথচ জেলের ভেতর বসেই তার কানে ভাসে শিশুপুত্র রাসেলের আব্বা ডাক। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চরিত্র মাধুর্য এখানেই যে তিনি জাতির কাছে দায়বদ্ধ। তিনি তো ইতিহাসের মহানায়ক। লেখক লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং রাজনীতির উত্থান-পতন, রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় আসে ছয় দফার ঘোষণা। এক পর্যায়ে ছয় দফাকে ঘিরেই পাকিস্তানের রাজনীতি আবর্তিত হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে অগ্নিপুরুষ রূপে আবিভূর্ত হন শেখ মুজিব।’

মূলত উপন্যাসটির চরিত্রের রূপায়ণ ঘটে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই। বঙ্গবন্ধুর প্রভাবে অন্যান্য চরিত্রগুলো তেমন আলো জ্বালাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর কাছে সবাই ম্লান। ঔপন্যাসিক এখানে ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। কারণ ইতিহাস কিন্তু এমনটাই সাক্ষ্য দেয়। উপন্যাসের একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, ‘২১ এপ্রিল ভোর থেকে শেখ মুজিবের বাসার চারদিকে পুলিশ ঘিরে আছে। গেটের সামনে কয়েকজন অফিসার ওয়াকিটকিতে কথা বলছেন। ওয়াকিটকিতে যে কথা হচ্ছে তা ভাঙা ভাঙা। সে কথাগুলো আবছা ভাবে বোঝা যায়।’ ‘আর দেরি করো না। শেখ সাহেবের কাছে খবর পাঠাও। তাকে গ্রেপ্তার করো। উপরের নির্দেশ আছে। উনি পালানোর মানুষ না। তোমরা খবর পাঠালেই উনি বেরিয়ে আসবেন।’ এ কথাগুলো দ্বারা বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের বিষয়টি বোঝা যায়। তিনি মুক্তিকামী জনতার কণ্ঠস্বর। জনতা স্লোগান দেয়। অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিব। স্লোগানের এই বিন্দুতেই ঔপন্যাসিকের পক্ষপাত। তাই তো তিনি নাম দিয়েছেন ‘অগ্নিপুরুষ’।

আলোচনা শুরুতে বলেছি লেখকের কাছে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবনের থেকেও রাজনৈতিক জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেননা তাঁর নেতৃত্বের সম্মোহনী শক্তি, ব্যক্তিত্ব, আবেগ উচ্ছ্বাস, দৃঢ়তা, ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির প্রকাশ এবং সর্বোপরি ইতিহাসের মহানায়কে পরিণত হওয়ার বিষয়টি ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক জীবনের বাইরে তাঁর পারিবারিক জীবনের নিখুঁত ছবি এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। তিনি পিতা হিসেবে, স্বামী হিসেবে এবং পরিবারের প্রধান কর্তা হিসেবে কতটা আন্তরিক ছিলেন তা লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি বললেন- ‘রাসেলকে কোলে নিয়ে শেখ মুজিব খাটের ওপর বসলেন তাঁকে ঘিরে কামাল, জামাল ও রেহানা, হাসিনাও এক পাশে গিয়ে বসলেন। ফজিলাতুন্নেসা রেনুও তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। চা খেতে খেতে শেখ মুজিব পরিবারের সবার খোঁজ-খবর নেন।’

উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের গভীরতা বোঝাতে লেখক বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি তৎকালীন বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা ও তাদের অবদান স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকেই বলিয়েছেন। ছয় দফার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমগুলো সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ। এদের মধ্যে ইত্তেফাক ছিল একেবারে আলাদা। আইয়ুব সরকারের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ইত্তেফাকে রাজনৈতিক মঞ্চ কলাম চালু করেন। ঔপন্যাসিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আর ইত্তেফাক হচ্ছে পরস্পরের পরিপূরক। আওয়ামী লীগ যা করে তা যদি ইত্তেফাকে না থাকে তাহলে মানুষ ঐটা পড়বে কেন? আওয়ামী লীগকে যারা ভালোবাসে তারাই এই পত্রিকা পড়ে।’ কিন্তু পাকিস্তান সরকারের তোপের মুখে ইত্তেফাক পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘হায়রে দেশ! আইয়ুব-মোনেম মিলে দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। যেই প্রতিবাদ করে তারই টুটি চেপে ধরে। কী এক বর্বর শাসনের মধ্যে আছি আমরা। মানিক ভাই জেলে। তাঁর পত্রিকাও বন্ধ। কে আর লিখবে এসব দুঃশাসনের বিরুদ্ধে।’

মূলত এ কথা দ্বারা তৎকালীন দুঃসহকাল তুলে ধরা হয়েছে। এ রকম বহু দুঃসহকালে ত্রাতা হয়ে বাঙালির সামনে দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। লড়াই করেছেন পাকিস্তানি অপ-শাসনের বিরুদ্ধে। এভাবে নিরেট সত্যকে অক্ষুণ্ন রেখে সাহিত্যের পট নির্মাণ সহজ নয়। মোস্তফা কামাল কিন্তু সে কাজটিই অত্যন্ত সহজভাবে করেছেন। পাঠক অবলীলায় এ চরিত্রের সঙ্গে ভ্রমণ করতে পারেন দেশপ্রেম ও মানবিকতা বোধে। উপন্যাসের ক্ষেত্রে চরিত্র হয়ে ওঠাটা কিন্তু বেশ জরুরি। আর এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা সফল। মহাকালের পাতায় মহানায়ক থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন অগ্নিপুরুষ।

‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসের মতো অগ্নিমানুষ উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রে রেখে কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে এ উপন্যাসের কাল পরিক্রমার সমাপ্তি ঘটে। নেতার দেশপ্রেম, স্বদেশ ভাবনার অন্তরালে ঔপন্যাসিক বাঙালি জাতিসত্তার গভীর বোধকে জাগিয়ে তুলেছেন। অগ্নিমানুষ উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ও তাঁর চরিত্র চিত্রণ দেখে তাঁকে আমরা গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউসের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। প্রমিথিউস মানুষকে সৃষ্টি করে দেবতাদের আদলে। মানুষকে দেয় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর এবং আকাশের দিকে তাকাতে পারার ক্ষমতা। মানুষকে তৈরি করে তাঁর সৃজনশীল গুণ দিয়ে। কিন্তু মানুষ সৃষ্টি করে মানুষের প্রতিই দুর্বল হয়ে পড়ে প্রমিথিউস। প্রমিথিউস যেমন মানুষকে ভালোবেসেছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধুও মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। প্রমিথিউস মানুষকে দিয়েছিল সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য অবলোকনের দৃষ্টি। তেমনি বঙ্গবন্ধু বাঙালির বুকে গেঁথে দিয়েছিলেন অফুরান সাহস। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বুকভরে শ্বাস নিতে হয়। প্রমিথিউস মানুষকে দিয়েছিল আগুন আর বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসের কাহিনিতে দেখা যায়, পাকিস্তানি শাসকদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু যে সাহসী মানুষ ছিলেন তা এই উপন্যাসে দেখা যায়। উপন্যাসটির সবথেকে প্রাণবন্ত মুহূর্তের মধ্যে অন্যতম হলো ভুট্টোকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চলমান আলাপ। বঙ্গবন্ধু চরিত্রের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতা এবং ইয়াহিয়া চরিত্রের শঠতা পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে অধিবেশন ডাকার মতো একটা কৌশল অবলম্বনে এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আন্দোলনের ডাক- এই দুই বিপরীত বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে এই মুহূর্তের পরিবেশ। ইয়াহিয়া খান-ভুট্টোর দ্বন্দ্ব তৈরির কথা বললে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের মানা না মানার ওপর যদি আপনার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে তাহলে তো এমন হবেই। আপনি কখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আপনার দায়িত্ব ছিল যথাসময়ে অ্যাসেম্বলি কল করা। তা করেননি। হঠাৎ আমি খবর পেলাম পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য কী?’

ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পেরে ওঠেননি। বঙ্গবন্ধুর দাবি ছিল নির্বাচন দিতে হবে। পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া একদিকে নির্বাচন দেন অপর দিকে মনে মনে ফন্দি আঁটেন। ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইয়াহিয়া খান তিন মাস নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন বঙ্গবন্ধুকে। ঔপন্যাসিক ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর মনের ভাব ব্যক্ত করতে বর্ণনা করেছেন- ‘শেখ মুজিব মনে মনে ভাবেন, আমার এখনও অনেক এলাকা যাওয়া বাকি আছে। আর তিন মাস সময় পেলে মন্দ হয় না। আর ইয়াহিয়া ভাবেন, নির্বাচনী প্রচার করতে করতে শেখ মুজিব টায়ার্ড হয়ে যাবে। টাকা-কড়িও শেষ হয়ে যাবে। সেই সুযোগে মুসলিম লীগসহ ইসলামী দলগুলোকে টাকা-পয়সা দিয়ে চাঙ্গা করবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে দুজনই ছিলেন বেশ সচেতন। বঙ্গবন্ধুও বুঝতেন সুযোগ পেলেই ইয়াহিয়া খান নানা অপকৌশল করবে। বঙ্গবন্ধু সেভাবেই তাঁর কর্ম পরিকল্পনা করেন।’

এই উপন্যাসে আমরা লক্ষ করি নির্বাচনের তারিখ ঠিক হওয়ার পর নির্বাচনকালীন যে দীর্ঘ ঘটনাপঞ্জি লেখক তা একেবারেই ফলাফলের ঘটনা দ্বারাই তুলে ধরেছেন। ইয়াহিয়ার কাছে যতবার গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে ততবারই দেখা গিয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাত্র কয়েকটি আসনে জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঠের প্রকৃত খবর ইয়াহিয়াকে না দিয়ে যে খবর শুনলে তিনি খুশি হবেন সেই খবর দেয়ার চেষ্টা করেছে সরকারি সংস্থা। কিন্তু নির্বাচনকালীন কোনো ঘটনা উল্লেখ না করা হলেও ফলাফলের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের শক্তি নির্ধারিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হন মহিমান্বিত।

 

আলোচ্য উপন্যাসগুলোতে ঐতিহাসিক কাহিনির পাশে কাল্পনিক অনেক ঘটনা সংযুক্ত হয়েছে। ইতিহাসের চরিত্র ও ঘটনাকে উজ্জ্বল করতে ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসে বহু অপ্রধান চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। যাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গ উপন্যাসের কাহিনিকে পূর্ণতা দান করেছে। যেমন, অগ্নিপুরুষ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বঙ্গবন্ধুর পাশে অসংখ্য অপ্রধান চরিত্র আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঔজ্জ্বল্যের কারণে বাকি চরিত্রগুলো তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কিন্তু প্রভাব বিস্তার করার মতো অসংখ্য চরিত্র ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ মণিসহ অসংখ্য চরিত্র নির্মাণে ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব রয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় অন্যান্য চরিত্র অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে। মূলত বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের অপরাপর চরিত্র আবর্তিত হয়েছে।

‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসের আখ্যানভাগ জুড়ে রয়েছে ৬৬-র ছয় দফা ও ৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস। পাকিস্তানের লাহোরে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিমানবন্দরে পা রেখে ফেলেছিলেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। এভাবেই অনেকটা নাটকীয়তার ঢঙে এর কাহিনি শুরু। এরপর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শঙ্কা ও তার চ্যালা-চামুণ্ডাদের নানা অপতৎপরতা। তার সেনাপতি মুসা খান, ইয়াহিয়া খান, গভর্নর মোনায়েম খান এবং সরকারের নানা-রকম কার্যকলাপ মূলত এই উপন্যাসের মূল কাহিনির আড়ালে শাখা-কাহিনি হিসেবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই সব কাহিনির আড়ালের মানুষটিও বঙ্গবন্ধু। জেল থেকে ফিরে আসা, আসার পর একের পর এক ষড়যন্ত্র ও নানা অপকৌশলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ঘায়েলের চেষ্টা আর আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার অপতৎপরতা এবং বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন কাঠামোর ভেতরে কিছু শাখা-কাহিনি গড়ে উঠেছে। মূল আখ্যানের মধ্যে দাঁড় করানো ঘটনায় সেগুলো প্রভাব বিস্তার করেছে। আইয়ুব খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথন বা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাদের ভাবনা উপন্যাসের গতিকে বেগবান করে। মূলত উপরে উপরে আইয়ুব খান অনেক তেজদীপ্ত কথা বললেও বঙ্গবন্ধুকে তিনি ভয় পেতেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দেশপ্রেম, দেশকে পাকিস্তানের অধীন থেকে মুক্ত করার বাসনা পাকিস্তানি শাসকদের ভাবিয়ে তুলেছিল। ‘আমার মনে হয় সে অনেক বেশি দূরদর্শী নেতা’ আইয়ুব খানের এই কথাটি অনেক তাৎপর্য বহন করে। কেননা পাকিস্তান শাসকের কাছে বঙ্গবন্ধু চরিত্রটির স্বরূপ উন্মেচিত হয়েছে।

‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাসে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তল্পিবাহক চরিত্রগুলো নেতিবাচক দৃষ্টিতে রূপায়িত। এর মাধ্যমেই মোস্তফা কামাল কাহিনিকে বাস্তবধর্মী করে তুলেছেন। যে চরিত্রকে যেভাবে তুলে ধরলে ইতিহাসের দায়বদ্ধতা রক্ষিত হবে তিনি সেভাবেই তাদের তুলে ধরেছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের চরিত্রটি স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার উৎকণ্ঠা ভেতরে বাইরের দ্বন্দ্ব, কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা, ভাড়ামি এবং নানা কূটকৌশল সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া তথা খলনায়কে পরিণত হওয়ার বিষয়টিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে রূপায়িত করেছেন। উপন্যাসে আইয়ুব খানের প্রধান সেনাপতি মুসা খান, সেনাপতি ইয়াহিয়া খান তোষামুদে চরিত্র। এভাবে ইতিহাসের চরিত্র ও ঘটনাকে উজ্জ্বল করতে বহু অপ্রধান চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। তাদের ব্যক্তিত্ব ও পারিবারিক জীবনের নানা প্রসঙ্গ উপন্যাসের কাহিনিকে পূর্ণতা দান করেছে। বিশেষ করে মতিয়া চৌধুরীকে কেন্দ্র করে তাঁর পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ ও মাতা নূরজাহান বেগমের প্রত্যহিক জীবনের অনেক ছোট ছোট ঘটনার সন্নিবেশ ঘটেছে। চাল বিক্রেতা রহিম বক্স, মাছ বিক্রেতা, মুরগি বিক্রেতা এবং সবজি বিক্রেতা তাদের স্বরূপে চিত্রিত হয়েছে। লেখক মোনায়েম খানের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ফোন পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন মোনায়েম খান। তিনি স্যার স্যার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছেন। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট সাহেব বলতে বাধ্য হলেন, এত স্যার স্যার বলার দরকার নেই।’

‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসেও অগ্নিপুরুষ উপন্যাসের মতো উপ-কাহিনি গড়ে উঠেছে। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন লেখক। ঔপন্যাসিক মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন অবস্থা বোঝানোর জন্য অনেক ছোট ছোট ঘটনার আশ্রয় নিয়েছেন। তৎকালীন তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানীসহ অনেকের ভূমিকা স্বল্পায়তনে উঠে এসেছে। উপন্যাসের অনেক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কথাও ফুটে উঠেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও তাদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রসঙ্গটি অগ্নিকন্যা ও অগ্নিপুরুষ উপন্যাসেও সমানভাবে এসেছে। সংবাদ, ইত্তেফাক পত্রিকার ওপর পাকিস্তানি সরকারের নানা নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ নির্লিপ্ত থাকেননি। শহীদুল্লা কায়সার, বজলুর রহমান, সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ অনেকের লেখনি ও আলাপচারিতায় সে সময়ের নানা দিক উঠে এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, চীনের নেতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের কথাটি বেশ জোরালোভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ভারতের কথা মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের প্রসঙ্গটি লেখক আলাদাভাবে উপন্যাসের কাহিনির ভেতর স্থান দিয়েছেন।

 

বাস্তবকে বাস্তবে রেখে উপন্যাসের শৈলি নির্মাণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে বাস্তবতা থেকে যত দূরে যাওয়া যায় ততই সৃষ্টিশীলতায় সফল হওয়া যায়। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত উপন্যাসে দেখা যায় বাস্তবতাকে ক্ষুণ্ন না করে তাকে আপন সৃষ্টিকর্ম করে তুলেছেন ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল। এই বাস্তবতা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। অন্যদিকে ভাষার ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল যথেষ্ট মনোযোগী। কাব্যিক, গম্ভীর, সাবলীল গদ্যশৈলির অনুসরণ রয়েছে ট্রিলজিতে। ভাষার মধ্য দিয়েই আখ্যান বিশেষ দেশকাল পরিপ্রেক্ষিত ছাড়িয়ে কল্পনার নীলাকাশে পক্ষ বিস্তার করেছে। অগ্নিকন্যা, অগ্নিপুরুষ ও অগ্নিমানুষ উপন্যাসত্রয়ীর ভাষা সহজ, গতিশীল এবং জটিলতা বিবর্জিত। সংলাপগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে পড়লে মনে হবে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোই কথা বলছে। কোনো চরিত্রকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। কোনো অতিরঞ্জিত তথ্যও নেই। কাহিনি পড়তে পড়তে পাঠকরা ইতিহাস জানবেন। কাহিনিই পাঠককে ভেতরে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ ইতিহাসের শুষ্ক ভাষাকে তিনি সহজ ও সাবলীল গদ্যে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসকে তিনি জীবন দান করেছেন; ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনা এবং ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর কথোপকথনের ক্ষেত্রে তাঁকে কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিতে হয়েছে। তবে ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত না হলে রাজনৈতিক ইতিহাসের ঘটনাগুলো লেখা যায় না। আর সেই ঘটনাবহুল সময় ছিল নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। কল্পনাশক্তির মাধ্যমে সেই সময়কে জীবন্ত করে তুলতে হয় লেখককে।

মূলত নানা বর্ণনায় সমকালীন যুগচিত্রের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ট্রিলজিতে। এখানে মোস্তফা কামালের গতিময় ও আবেগপূর্ণ বাক্য, বিদগ্ধ শব্দ গাঁথুনি এবং প্রাসঙ্গিক প্রবাদ-প্রবচন ও লোকসংগীতের ব্যবহার উপন্যাসের ভাষাশৈলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। মোটকথা ইতিহাসের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপন্যাসের অগ্নিপুরুষ রূপে চিত্রিত হয়েছেন। অগ্নিপুরুষের মতো অগ্নিমানুষ উপন্যাসের ভাষা সহজ-সরল ও গতিময়। লেখক যেহেতু ইতিহাসের আদলে উপন্যাসটি রচনা করেছেন তাই এর পাঠক আপামর বাঙালি। তাই সরল বর্ণনায় পাঠকের কাছে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেছেন। মোস্তফা কামাল বঙ্গবন্ধুর মুখ দিয়ে অনেক জায়গায়ই ছোট ছোট বাক্য ফুটিয়ে তুলেছেন যা অনেকটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসের সংলাপের মতো। যেমন নির্বাচন নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে কথোপকথন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনি যখন বলছেন ডিসেম্বরে করবেন, আমার আপত্তি নেই। তবে এর পর আর পেছাবেন না। ইয়াহিয়া : না না! পেছানোর প্রশ্নই আসে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।’ মোট কথা ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাস তিনটির মাধ্যমে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি স্বমহিমায় বিন্যস্ত করেছেন।

 

মূলত কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাসত্রয়ীতে বঙ্গবন্ধুকে জীবন্ত করে তুলেছেন। উপন্যাসগুলোতে ঐতিহাসিক অংশের প্রাধান্য থাকায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যে পড়ে সৃজিত চরিত্রগুলো পরস্পরের কাছে এসেছে, সেখানে তাদের মানসিক সংঘর্ষ ও পরিবর্তনের চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। ইতিহাস আখ্যানের পারিবারিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত। অর্থাৎ ইতিহাস বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পারিবারিক জীবনকে আলিঙ্গন করে এগিয়ে চলেছে। এ জন্য কাহিনিতে মানুষের সাধারণ মনোবৃত্তিসমূহ, প্রেম, ঈর্ষা, বন্ধুত্ব অঙ্কিত হয়েছে; ইতিহাসের জটিল-কুটিল দৃষ্টির তলায় আবর্তিত হয়েছে মানবতা। কাহিনির বৃহত্তর সংঘটনের মধ্যে কিংবা যুগান্তকারী ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে নিম্নবর্গের মানুষ উপেক্ষিত হলেও সর্বক্ষেত্রে নয়। যদিও আখ্যানের চরিত্রসমূহ প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কখনো উচ্চপদস্থ। তাঁরা রাজনৈতিক আবর্তের বিক্ষোভ-বিকম্পিত ইতিহাসের গর্ভের ভেতর জন্মগ্রহণ করে বর্ধিত হয়েছেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বিশাল ইতিহাস ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত জীবনকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। তবে ঐতিহাসিক কোলাহলের মধ্যে নিজ নিজ কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেননি অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। আর ইতিহাসের প্রবল আকর্ষণে শাখা-কাহিনির সাধারণ জীবন তার স্বভাবমন্থর গতি হারিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার বেগবান প্রবাহে চলতে বাধ্য হয়েছে। সব মিলে মোস্তফা কামাল বঙ্গবন্ধুকে নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে আঁকতে গিয়ে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাস।

Header Ad

জিম্বাবুয়েকে হেসে-খেলে হারাল টাইগাররা

ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে সফরকারী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সহজ জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।

শুক্রবার চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের দেওয়া ১২৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২৮ বল ও ৮ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ দল।

১২৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ৫ রান তুলতেই লিটনের উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ৩ বলে ১ রান করে সাজঘরে ফিরেন টাইগার ওপেনার লিটন কুমার দাস। এরপর ধীর গতির ব্যাট করেন নাজমুল শান্ত। আউট হওয়ার আগে তিনি ২৪ বলে ২১ রান করেন। এরপর তানজিদ তামিম ও তাওহীদ হৃদয় ঝড়ো ব্যাটিং করে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। অভিষিক্ত তানজিদ তামিম ৪৭ বলে ৬৭ রান করেন ও তাওহীদ হৃদয় ১৮ বলে করেন ৩৩ রান।

এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় ওভারেই প্রথম উইকেট হারায় জিম্বাবুয়ে। মাহেদী নিজের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই সরাসরি বোল্ড করে ফেরান জিম্বাবুয়ের ওপেনার ক্রেইগ আরভিনকে (০)। এরপর শরিফুল ইসলাম এক ওভারে তিন বাউন্ডারি সহ হজম করেন ১৩ রান। কিন্তু তাসকিন আহমেদ এসে রানের চাকায় লাগাম টানেন। যার ফল তুলে নেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। প্রথমবার বল হাতে নিয়ে দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন সাইফউদ্দিন।

ওভারের শেষ বলে তিনি জিম্বাবুয়ের অভিষিক্ত ব্যাটার জয়লর্ড গাম্বিকে (১৪) বিদায় করেন। উইকেট পতনের মিছিল এরপর চলতেই থাকে। ষষ্ঠ ওভারে ফের বল হাতে নেন মাহেদী। এবার প্রথম বলেই রান আউটের শিকার হন একপ্রান্ত আগলে রাখা ব্রায়ান বেনেট (১৬)।

পরের বলে এসেই ডাক মারেন জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক সিকান্দার রাজা। মাহেদীর লেন্থ বলে প্যাডেল সুইপ খেলতে গিয়ে ফার্স্ট স্লিপে থাকা লিটন দাসের হাতে ক্যাচ তুলে দেন রাজা। ১ উইকেটে ৩৬ রান করা জিম্বাবুয়ে আর কোনো রান যোগ করার আগেই হারায় আরও ৩ উইকেট।

এখানেই শেষ নয়। তাসকিন পরের ওভারে তুলে নেন জোড়া উইকেট। ওভারের প্রথম দুই বলেই তিনি বিদায় করেন শন উইলিয়ামস ও রায়ান বার্লকে। দু’জনেই বিদায় নিয়েছেন রানের খাতা খোলার আগেই। এরপর অষ্টম ওভারে লুক জঙওয়ে (২) বিদায় নেন সাইফউদ্দিনের বলে।

৪১ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে সঙ্গে নিয়ে ক্লিভে মাদানদে ইনিংস গড়ার দায়িত্ব নেন। শুরুতে তারা ধীরস্থিরভাবেই খেলছিলেন। কিন্তু শেষদিকে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন তারা।

শরিফুলের করা ১৭তম ওভারে ১১ ও রিশাদ হোসেনের করা পরের ওভারে ১৬ রান নেন মাসাকাদজা ও মাদানদে। এরপর ১৮তম ওভারের প্রথম বলে তাসকিনকেও ছক্কা হাঁকান মাসাকাদজা। এক বল পরই অবশ্য তার সঙ্গী মাদানদেকে বোল্ড করেন তাসকিন।

তার ইয়র্কার মাদানদের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে স্টাম্পে আঘাত করে। অষ্টম উইকেটে জিম্বাবুয়ের রেকর্ড ৬৫ বলে ৭৫ রানের জুটি ভেঙে যায় এতে। ৬ চারে ৩৯ বলে ৪৩ রান করে আউট হন মাদানদে। তার বিদায়ের পর জিম্বাবুয়ের রান হয়নি খুব একটা। শেষ বলে রান আউট হওয়ার আগে ৩৮ বলে ৩৪ রান করেন মাসাকাদজা।

বাংলাদেশের হয়ে ৪ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন তাসকিন। সমান ওভারে ১৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট পান সাইফউদ্দিনও।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করল তুরস্ক

ছবি: সংগৃহীত

গত ছয়মাস ধরে দখলদার ইসরাইল অবরুদ্ধ গাজায় নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩৮ হাজারের বেশি ফলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছেন লাখ লাখ। বাস্তহারা করেছে ২০ লাখের বেশি মানুষকে। এই হত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে চলছে প্রতিবাদ। তুরস্কে লাগাতার বিক্ষোভ মুখে ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ ও বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার তুরস্ক জানিয়ে দিয়েছে, গাজার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় তারা ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ রাখছে।

বলা হয়েছে, গাজায় যতদিন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন মানবিক ত্রাণ দিতে না দেয়া হচ্ছে, ততদিন বাণিজ্য বন্ধ রাখবে তুরস্ক।

তুরস্কের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ''ইসরায়েলের সঙ্গে সব পণ্যের আমদানি ও রপ্তানি বন্ধ থাকছে।''

দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় ৭৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এর আগে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান সমঝোতা ভেঙে ইসরায়েলের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন।

সামাজিক মাধ্যমে তিনি বলেছেন, ''এভাবেই একজন ডিক্টেটর কাজ করেন। তুরস্কের মানুষ, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ তিনি দেখলেন না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিও অবহেলা করলেন।''

তিনি বলেছেন, ''ইসরায়েল বিকল্প খুঁজে নেবে। অন্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাড়াবে।''

তুরস্ক গতমাসে জানিয়েছিল, তারা ইসরায়েল থেকে বাণিজ্যে কাটছাঁট করছে। সেসময় তুরস্কের অভিযোগ ছিল, তাদের বিমান গাজায় মানবিক ত্রাণ দিতে গিয়েছিল। ইসরায়েল তা করতে দেয়নি। তুরস্কে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে।

গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছে তুরস্ক। এর্দোয়ান তো ইসরায়েলকে 'সন্ত্রাসী রাষ্ট্র' পর্যন্ত বলেছেন।

অন্যদিকে এক বিবৃতিতে তুরস্ক জানিয়েছে, এই বাণিজ্য স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই কার্যকর হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তুরস্ক কঠোরভাবে ও সন্দেহাতীতভাবেই নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে যতদিন পর্যন্ত ইসরাইল সরকার গাজায় বাধাহীন ও পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রবাহের অনুমোদন না দেয়।’

১৯৪৯ সালে প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেশ দু’টির মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

২০১০ সালে গাজায় তুরস্ক মালিকানাধীন জাহাজ ইসরাইলের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করার সময় ইসরাইলি কমান্ডোদের সাথে সংঘর্ষে ১০ জন ফিলিস্তিনপন্থী তুর্কি কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনায় তুরস্ক কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিন্ন করেছিল।

পরে ২০১৬ সালে আবার দেশ দু’টির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপন হয়। কিন্তু এর দু’বছরের মাথায় উভয় দেশ একে অন্যের শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে গাজা সীমান্তে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনায়।

এরদোগান গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর ইসরাইলের তীব্র সমালোচনা করে আসছেন।

গত জানুয়ারিতে তিনি বলেন, ‘হামাসের হামলার জবাবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে সামরিক অভিযান চালিয়েছেন তা হিটলার যা করেছিল তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’

জবাবে নেতানিয়াহু বলেন, ‘এরদোগান, যিনি কুর্দিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সঙ্ঘটিত করেন এবং যিনি তার শাসনের বিরোধিতা করায় সাংবাদিক বন্দীর ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ড করেন, তিনিই হলেন শেষ ব্যক্তি যিনি আমাদের নৈতিকতা শেখাচ্ছেন।’

গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সমালোচনা বাড়ছে। জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে গত মাসে ১১ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধায় জর্জরিত ছিল এবং এ মাসের মধ্যে গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস বলেছে, গাজা উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী যে বন্দর নির্মাণ করেছে ত্রাণ প্রবাহ বাড়ানোর জন্য সেটি কয়েক দিনের মধ্যেই উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

ভাসমান ওই বন্দরে নৌযান ও লোকজনের কাজের ছবিও প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তার কাছেই নৌবাহিনীর জাহাজ ছিল।

যদিও জাতিসঙ্ঘ বলেন, সামুদ্রিক করিডোর কখনো স্থলপথে ত্রাণ সরবরাহের বিকল্প হতে পারে না। আর সড়কপথ হলো একমাত্র উপায় যেখানে একসাথে অনেক পরিমাণ ত্রাণ নেয়া যায়।

এর আগে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বারবার অনুরোধের প্রেক্ষাপটে চলতি সপ্তাহে গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহের জন্য ইসরাইল ইরেয ক্রসিং আবার খুলে দিয়েছে।

তবে জর্ডান বলেছে, তাদের কিছু ত্রানবাহী লরি ওই ক্রসিং পার হওয়ার সময় ইসরাইলি বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের রিপোর্ট বলছে, গাজার মানবিক বিপর্যয় একটি মানব সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক সিনিয়র কর্মকর্তা ভলকার তুর্ক বলেন, এটা এখন ‘বিশ্বাসযোগ্য’ যে ইসরাইল ক্ষুধাকে গাজা যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

ইসরাইল ত্রাণ সরবরাহ সীমিত করার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটি গাজায় যাদের প্রয়োজন তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছে জাতিসঙ্ঘের বিরুদ্ধে।

৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিক্রিয়ায় হামাসকে ধ্বংস করতে গাজায় ইসরাইল যে সামরিক অভিযান চালিয়েছে তাতে ৩৪ হাজার ৫০০ মানুষের মৃত্যুর খবর দিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে, হামাসের হামলায় ইসরাইলে এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং তারা আরো ২৫৩ জনকে পণবন্দী করেছিল।

মধ্যস্থতাকারীরা এখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে সবশেষ আসা প্রস্তাবের বিষয়ে হামাসের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

খবর অনুযায়ী, এবারের প্রস্তাবে ৪০ দিনের যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে এবং এর বিনিময়ে ইসরাইলি বন্দী ও ফিলিস্তিনি কিছু বন্দী মুক্তি পাবে। সূত্র : বিবিসি

বাংলাদেশের কোনো ভাষাকেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না: প্রধান বিচারপতি

ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছন, বাংলাদেশের কোনো ভাষাকেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, যেকোনো মূল্যে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের মাতৃ (পার্সী)-ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। এর জন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

শুক্রবার (৩ মে) দুপুরে শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের গেস্ট হাউসে খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সাক্ষাতের সময় এ কথা জানান তিনি।

এ সময় খারিয়া জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। সাক্ষাতে শ্রীমঙ্গল বর্মা ছড়ার খাড়িয়া সম্প্রদায়ের দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা তাদের ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের সম্প্রদায়ের জহরলাল ইন্দোয়া নামের একজন তা বাংলায় বর্ণনা করেন।

সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবির, জেলা পুলিশ সুপার মো. মঞ্জুর রহমান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো আবু তালেব ও শ্রীমঙ্গল থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিনয় ভূষণ রায়।

প্রধান বিচারপতি জানান, ভাষা বৈচিত্রের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। তিনি গণমাধ্যমের সূত্রে জেনেছেন, খাড়িয়া সম্প্রদায়ের দুজন লোকই বেঁচে আছেন। যারা তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন। তারা মারা গেলে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে এই ভাষা। এই বিষয়টি তাকে ভাবান্বিত করেছে। তাই নিজ উদ্যোগেই এই দুজন মহিলার সঙ্গে তিনি দেখা করতে এসেছেন। তিনি আস্বস্ত হয়েছেন শুধু দুজন নয়, এই ভাষায় কথা বলতে পারেন আরও কয়েকজন আছেন এবং খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করছেন। তবে এই ভাষাটি রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণের ওপর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে উদ্যোগ নিতে বলেন।

এর আগে তিনি বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের আবিষ্কৃত চায়ের জাত ও তৈরি চায়ের গুণগত মান যাচাই করেন। এ সময় তিনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চায়ের গুণগত মান ধরে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান করেন।

সর্বশেষ সংবাদ

জিম্বাবুয়েকে হেসে-খেলে হারাল টাইগাররা
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করল তুরস্ক
বাংলাদেশের কোনো ভাষাকেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না: প্রধান বিচারপতি
বৃষ্টি হতে পারে যেসব বিভাগে, যে তথ্য দিল আবহাওয়া অফিস
ভূমধ্যসাগরে নিহত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ হস্তান্তর
কাল থেকে বাড়তি ভাড়ায় চড়তে হবে ট্রেনে, কোন রুটে ভাড়া কত
সবসময় আস্থা রাখায় ধোনিকে ধন্যবাদ জানালেন মোস্তাফিজ
সুষ্ঠু ভোটের আয়োজনে প্রার্থীদেরও ভূমিকা রয়েছে : ইসি রাশেদা
টাঙ্গাইলে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে গণমাধ্যমকর্মীদের সমাবেশ
গণতন্ত্রের জন্য লড়াইকারীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে : রিজভী
সরকারকে যারা চাপে রাখতে চেয়েছিল তারা নিজেরাই চাপে আছে : ওবায়দুল কাদের
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ, গ্রেপ্তার ২ হাজার
ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারালেন পুলিশ কর্মকর্তা
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা শনিবার
যেসব অভিযোগে ১১১০ দিন কারাগারে ছিলেন মামুনুল হক
শনিবার যেসব জেলার স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ থাকবে
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি!
নওগাঁয় আ.লীগ নেতার প্রচারে যাওয়া ছাত্রদলের ২ নেতাকে শোকজ
বলিউডের ছবিতে গাইলেন আসিফ আকবর
যাত্রীবাহী বাস উল্টে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত ২০