দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে নার্স সংকট। জনসংখ্যার অনুপাতে যেখানে কমপক্ষে ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ নার্স প্রয়োজন, সেখানে কর্মরত নার্সের সংখ্যা মাত্র ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন। ঘাটতি রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫৪ হাজার জনের বেশি, যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৮২ শতাংশ কম। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—‘নার্সরা সুস্থ থাকলে, দেশও সবল হয়’—সরাসরি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নার্সদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা ছাড়া স্বাস্থ্যখাতে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ প্রয়োজন। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে চিকিৎসক আছেন ৮৬ হাজার ৬৭৫ জন (প্রয়োজনের তুলনায় ১৬.৫ শতাংশ কম), নার্স আছেন ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন (৮২ শতাংশ কম), আর সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার ২১৯ জন, যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৫৫ শতাংশ কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নত ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩। অর্থাৎ, একজন চিকিৎসকের সঙ্গে থাকা উচিত তিনজন নার্স এবং আরও অন্তত পাঁচজন সহকারী স্বাস্থ্যকর্মী। অথচ বাংলাদেশে এই অনুপাত বর্তমানে মাত্র ১:০.৭।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্টাফ নার্স মল্লিকা বানু গণমাধ্যমকে বলেন, “আমার হয়তো ছয়জন রোগীর দায়িত্ব থাকার কথা, কিন্তু দিতে হয় ৫০ জনকে। এতে রোগীদের প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। একদিকে রোগী সন্তুষ্ট হয় না, অন্যদিকে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, সেবার মানও কমে যায়।”
শুধু সংখ্যা নয়, নার্সিং পেশার প্রতি সামাজিক অবহেলা ও কাঠামোগত অব্যবস্থাপনাও সংকট বাড়াচ্ছে। নিউইয়র্কভিত্তিক ‘সেজ’ প্রকাশনা সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নার্সিংকে এখনো অনেকেই নোংরা ও নীচু কাজ হিসেবে ভাবেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা বেশি এই পেশায় আসেন, এমন ধারণা রয়েছে সমাজে। এমনকি নারী নার্সদের পেশাগত দায়িত্ব—যেমন অন্য লিঙ্গের রোগীর যত্ন নেওয়া—নিয়ে সমাজে নানামুখী নেতিবাচক ধারণাও আছে।
নার্সিংয়ের শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত, আর সেই শিক্ষার কোনো স্বীকৃতি বা প্রভাব পড়ছে না চাকরি বা পদোন্নতিতে। গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েকজন নার্স পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেও তাঁদের পদ বা বেতন বাড়েনি।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইসমত আরা পারভীন বলেন, “নার্সদের সংখ্যা বাড়ানো, তাদের বেতন ও পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ—এসব নিশ্চিত না করলে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা সম্ভব নয়। ক্লান্ত, অবমূল্যায়িত নার্সদের দিয়ে উন্নত সেবা আশা করা ঠিক না।”