নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে
রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা ও স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতায় দেশে ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে পাঁচ বছরের ভিসায় বিদেশ গেলেও চলে আসতে হচ্ছে ছয় মাস বা এক বছরের মাথায়। সম্প্রতি বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এভাবে ফিরে এসেছেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্ব পালন করা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য ও ফিরে আসা শ্রমিকরা জানান, সম্প্রতি এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশ ফেরতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসার কারণে অনেক শ্রমিক ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত যেতে পারছেন না টাকার অভাবে।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের হেড শরিফুল হাসান শুধু সৌদি আরবের উদাহরণ দিয়ে ভয়াবহতা বোঝানের চেষ্টা করেন। অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ব্র্যাকের এই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ সৌদি আরব গেছে। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষই ফেরত এসেছে। গত ৫ বছরে ২০ লাখ মানুষ সৌদি আরব গেছে। সেখান থেকে বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছে কাজ না পেয়ে।
কারণ হিসেবে শরিফুল হাসান বলছেন, এজন্য আমাদের দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলা দায়ী। তারা শ্রমিকদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করছে, কেমন কাজ দিচ্ছে এগুলো দেখার বিষয়। যারা যাচ্ছেন তারা ওই সমস্ত কাজ পারেন কি না এবং নির্ধারিত কোম্পানির অধীনে কাজ পাবেন কি না— তা না যাচাই করেই মানুষ যাচ্ছে। এবং যথারীতি কাজ না পেয়ে তারা ফেরতও আসছেন।
দূতাবাসগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শরিফুল হাসান বলেন, দূতাবাসগুলোকে শ্রমিকদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। অনেকের কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও তারা ফিরে আসছেন অথবা ওই দেশের পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে কিছু দিন জেলে রেখে ফেরত পাঠাচ্ছে। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর শ্রমিকরা দূতাবাসে যোগাযোগ করলে তেমন প্রতিকার পাচ্ছেন না।
জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ মানুষ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ফেরত আসছে। এক্ষেত্রে এই শ্রমিকদের খুবই সামান্য পরিমাণ সহযোগিতা করে থাকেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও এপিবিএন। পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় এক্ষেত্রে নিঃস্ব এ সব শ্রমিককে সহযোগিতা করতে পারে না কর্তৃপক্ষ।
ফিরে আসা শ্রমিকরা জানান, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়েছে। কিন্তু এজেন্সিগুলো সঠিক ভিসা দেয়নি। যে কাজের ভিসা নিয়ে তারা বিদেশে গেছেন, সে কাজ বা বেতন কিছুই পাননি। বাধ্য হয়েই অন্য কাজ খুঁজতে গেলে তাদের আটক করে সৌদি পুলিশ। তখন তাদের কোনো কথা না শুনে তাদের জেলে পাঠানো হয়।
সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত আসা কর্মী যশোরের কামাল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা বৈধপথে সৌদি গিয়েছি। কিন্তু দেখা গেল রিক্রুটিং এজেন্সি সঠিক ভিসা দেয়নি। ফলে ওই দেশের পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করল এবং প্রায় একমাস কারাগারে রাখল। এরপর আমাদের এদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এর মধ্যে আমাদের লোকজন বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করলে তারা কিছু করেনি।
কামালের দাবি, রিক্রুটিং এজেন্সির ঘাপলার কারণেই এমনটা হয়েছে। দূতাবাস এক্ষেত্রে পাশে থাকলে আমাদের এভাবে নিঃস্ব হয়ে ফিরতে হতো না।
ফেরত আসা আরেকজন শ্রমিক চট্টগ্রামের টিপু বলেন, এজেন্সির প্রতারণার কারণে বিদেশ থেকে ফেরত আসতে হয়েছে আমাদের। আমার মতো অসংখ্য শ্রমিক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিপদে পড়লে বাংলাদেশ দূতাবাসেরও সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে এমন প্রতারণার জন্য এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে টিপু বলেন, যাতে করে আমাদের মতো এভাবে অন্যদের প্রতারণার শিকার হতে না হয়।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা সৌদিপ্রবাসী হাবিব ইসলাম ওরফে সোহেল। পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর আশায় রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। ছয় বছর পর দেশে ফেরার কথা থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই ফিরেছেন শূন্য হাতে।
সোহেল জানান, আকামা, পাসপোর্ট সব আছে। তারপরও পাসপোর্ট, মোবাইল সব কেড়ে নিয়ে গাড়িতে করে তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয় সৌদি পুলিশ। সেখান থেকে খালিহাতে পাঠানো হয় দেশে।
প্রবাসীদের দাবি, তাদের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। তা সত্ত্বেও নানা অজুহাতে সৌদির কারাগারে পাঠানো হয় তাদের। সেখানে একই রুমে গাদাগাদি করে রাখা হয় কয়েকশ প্রবাসীকে। পরে তাদের জোরপূর্বক এক কাপড়ে দেশে ফেরত পাঠায় সৌদি সরকার।
সম্প্রতি এক কাপড়ে প্রায় আড়াই শতাধিক শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি আরব। রবিবার (৩০ এপ্রিল) সাউদিয়া এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে এ সব শ্রমিক ফেরত আসেন।
ফিরে আসা এসব শ্রমিক ছয় থেকে দশ মাস আগে বৈধ কাগজপত্র নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানোর জন্য পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় বিদেশে গিয়ে এ সব শ্রমিক প্রতিশ্রুত কাজ পান না। কাউকে কাউকে আবার ভিজিট ভিসা দিয়ে পাঠানো হয়। ফলে অবধারিতভাবে তাদের ফিরে আসতে হয়।
সৌদি থেকে ফেরত আসা চট্টগ্রামের ফিরোজ বলেন, একটি এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে গেলাম। আকামাসহ সকল প্রকার বৈধ কাগজপত্র থাকার পরেও দেশে ফেরত আসতে হলো। এয়ারপোর্টে এসে মানুষের কাছে ধার করে গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশ দূতবাসের কর্মরত ও ওই দেশের পুলিশের হাতপায়ে ধরেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
ফেরত পাঠানো একাধিক প্রবাসী জানান, জেলে প্রায় এক মাস ধরে আটকে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়।
দেশে ফেরত আসা একাধিক প্রবাসী শ্রমিকের দাবি- এক রুমে প্রায় এক থেকে দেড়শ লোককে আটকে রাখা হয়। খাবার ছিল না, পানি ছিল না। একজনের ওপর আরেকজন শুয়ে থাকতে হতো। তাদের কাছে কোনো টাকা নেই। এখন বিমানবন্দরে এসে নেমেছেন, কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার মতো ভাড়ার টাকাও নেই।
ফেরত পাঠানো আরেক শ্রমিক বলেন, ‘আমার এখনও আকামা আছে আট মাসের। তারপরও আমাকে এসে সৌদি পুলিশ ধরল। বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সহযোগিতা করেনি।
ফেরত পাঠানো এই শ্রমিকদের কেউ ১০ মাস, কেউ এক বছর, দু-বছর, কেউবা আবার ছয়-সাত বছর সৌদিতে থাকলেও তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য শ্রমিক দেশে প্রবেশ করছে। অনেক সময় তাদের প্রবাস জীবনের গল্প শুনে আমাদের খুব খারাপ লাগে। ফেরত আসা শ্রমিকদের আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।
জিয়াউল হক আরও বলেন, দুঃখ-কষ্ট নিয়ে ফেরত আসা শ্রমিকদের বিষয়ে জানতে পারলে নিজেদের সাধ্য মতো তাদের সহযোগিতা করে থাকে এপিবিএন। কিছু কিছু সময় এজেন্সির প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করে থাকি।
আরইউ/আরএ/