সারাদেশ

বর্ণিল আয়োজনে প্রধান শিক্ষকের রাজকীয় বিদায়, কান্নায় ভাসলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী


সারাদেশ ডেস্ক
প্রকাশ :০২ জুলাই ২০২৫, ০৯:২০ পিএম

বর্ণিল আয়োজনে প্রধান শিক্ষকের রাজকীয় বিদায়, কান্নায় ভাসলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী
ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ ৩১ বছরের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিনে রাজকীয় বিদায় পেলেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ৫৩ নম্বর লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক।

বুধবার বিকেলে বিদ্যালয় চত্বরে আয়োজিত এক হৃদয়ছোঁয়া বিদায় সংবর্ধনায় ফুলেল শুভেচ্ছা, ছাদ খোলা গাড়ি, বাদ্যযন্ত্র আর শতাধিক মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে তাকে বিদায় জানানো হয়। বিদায় বেলায় শিক্ষার্থীরা দুই লাইনে দাঁড়িয়ে ফুল ছিটিয়ে প্রিয় শিক্ষককে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন আবু বক্কর সিদ্দিক।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিদায় সংবর্ধনা এক আবেগঘন মিলনমেলায় রূপ নেয়। বিদায় মুহূর্তে শিক্ষার্থীরা প্রিয় স্যারের পায়ে লুটিয়ে পড়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।

বিদায়ী বক্তব্যে আবেগাপ্লুত হয়ে আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, “৩১ বছর ৭ মাস ১৫ দিন কর্মজীবনের শেষ সইটি যখন করলাম, হৃদয়ের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করলাম। এই ভালোবাসা, সম্মান জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। চলুন আমরা সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি, তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে।”

বিদায় অনুষ্ঠানে সাবেক ছাত্র-ছাত্রীরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসে স্মৃতির পাতায় স্যারের সঙ্গে একটি ছবি বন্দি করার চেষ্টা করেন। কেউ আবেগে ভেসেছেন, কেউবা স্মৃতি ধরে রাখছেন মোবাইলের ক্যামেরায়।

সহকর্মী শিক্ষকরা আবু বক্কর সিদ্দিকের প্রশংসায় বলেন, “তিনি ছিলেন এই এলাকার শিক্ষার বাতিঘর। তার নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, পরিবেশ ও শৃঙ্খলায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। এমন শিক্ষক খুব কমই হয়।”

অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবৃত্তি, স্মৃতিচারণ, বিদায়ী গান এবং ভালোবাসা জানিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুলে ফুলে সজ্জিত ছাদ খোলা গাড়িতে তাকে বিদ্যালয় চত্বর প্রদক্ষিণ করানো হয়, যা পুরো আয়োজনকে করে তোলে স্মরণীয়।

বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি কামিনি কান্ত রায় এবং সঞ্চালনায় ছিলেন অনুষ্ঠানের সদস্য সচিব সাইদুর রহমান সোহাগ। প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা গীতা রানী সরকার।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোপাল চন্দ্র দেব শর্মা, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান বাবু, বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিপিকা রায়, সহকারী শিক্ষক খাদিজা শাপলা ও আফসানা নাহারসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ।

মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ১৯৯৩ সালে পলাশবাড়ী-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১০ সালে তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় তার নেতৃত্বে বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য, সমাজসেবা ও ধর্মীয় অঙ্গনে অবদান রেখেছেন। তিনি ‘লক্ষ্মীপুর মিতালী সংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ‘বীরগঞ্জ সাহিত্য সংসদ’-এর সহ-সভাপতি এবং লক্ষ্মীপুর জামে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। তার লেখা ছড়াগ্রন্থ ‘ছন্দে ছন্দে শিখি আনন্দে’ শিশু-কিশোরদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া তিনি বহু কবিতা ও ছড়া রচনা করেছেন।

বিদায় সংবর্ধনা শেষে এলাকাবাসী বলছেন, “স্যারের মতো একজন আলোকিত মানুষকে আজ সসম্মানে বিদায় দিতে পেরে আমরাও গর্বিত।”

এমন বর্ণিল বিদায় দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মত অনেকের।