বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫ | ১২ আষাঢ় ১৪৩২
Dhaka Prokash

বাংলার বাউলের প্রাণপুরুষ মহাত্মা লালন: বিশেষজ্ঞ ভাবনা

লালন গবেষকরা তাদের গবেষণায় লালনের জীবনদর্শন থেকে শুরু করে শৈল্পিক ও কবিত্বশক্তি উদঘাটনে এবং শিল্পী সত্তার মূল্যায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লালনের গান বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ, লালন সাধনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, সুফিদর্শন, বৈষ্ণবশাস্ত্র সম্পর্কে তত্ত্বজ্ঞান, দিব্যদৃষ্টি সবই তার অসামান্য অবদান। দেশি-বিদেশি গবেষকেরা লালন নিয়ে গবেষণার জ্যোতি ছড়িয়ে চলেছেন। লালন দেশের কাঁটাতার ছিন্ন করে বিশ্বের ওপাড়ে ও মনের মানুষের হৃদয়েও তুলেছেন সুরের প্রাণবস্ত মূর্ছনা:
‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে’...

ফকির লালন শাহ্’র জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র

৫ মে ১৮৮৯ সালে শিলাইদহে পদ্মা বোটের উপর বসা অবস্থায় এঁকেছিলেন চিত্রশিল্পী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, যা বর্তমানে ভারতের যাদুঘরে রক্ষিত আছে। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম প্রধান ও ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যার যুগান্তকারী গানের মাধ্যমে উনিশ শতকে বাউল গান অধিকতর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য আঠার শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান যেমন মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ ধারা তেমনই বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন। মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা ‘হিতকরী’তেই প্রকাশিত রাইচরণ দাস এর এই একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ গান্ধীজীর ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম লালনকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিলো।

রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব পড়েছিল। গীতাঞ্জলির অনেক গানে-তার জীবনদর্শনে লালন তাকে প্রভাবিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণায়--Lalon is the king of the Bauls--সবচেয়ে বড় মরমি-শ্রেষ্ঠ বাউল। সুফিকবি জালালউদ্দিন রুমিকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যে ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে-চেতনা জেগেছে, লালনকে নিয়েও এমন হবে। মুচকুন্দ দুবের লালনের গানের হিন্দি অনুবাদের বই ‘লালন শাহ ফকির কী গীত’ প্রকাশ পায় ভারতের দিল্লির সাহিত্য একাডেমি থেকে। এতে মুচকুন্দ দুবের দীর্ঘ ভূমিকাসহ লালনের ১০৫টি গান স্থান পেয়েছে।

বিশিষ্ট লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ গ্রন্থে (উপসম্পাদকীয় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ পাক্ষিক ‘হিতকরী’, ১ম ভাগ, ১৩শ সংখ্যা, ১৫ কার্তিক ১২৯৭, ৩১ অক্টোবর ১৮৯০) অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন: ‘আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন; সম্প্রদায়ের ধর্ম্ম-মতানুসারে ইহার কোনো সন্তান-সন্ততি হয় নাই। ...ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত: কিছুই বলিতে পারে না।’ লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। লালন গবেষণার পথিকৃত শ্রীবসন্ত কুমার পাল এর মতে, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাঁড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। ‘হিতকরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়েছে, লালন তরুণ বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথিরা তাকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালীগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মওলানা মলম শাহ। মওলানা মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান বিবি তাকে সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। গুটি বসন্ত রোগে তিনি একটি চোখ হারান। ছেঁউড়িয়াতে পালিত মাতা ও পিতার অনুরোধে লালন বসবাস শুরু করেন এবং ছেঁউড়িয়াতেই থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গার সাধক-সন্ন্যাসীরা তার এখানে আসা-যাওয়া শুরু করেন। এই সময় সিরাজ সাঁই নামক একজন সুফি দরবেশ ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাত হয় এবং তার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। লালনের অনেক পদে দরবেশ সিরাজ সাঁই এর নাম উল্লেখ আছে। তার পালিত মাতা বসবাসের জন্য নিজ বাড়ির কাছেই (বর্তমান মাজার আঙ্গিনায়) ঘর তুলে দেন। লালন অশ্বারোহণে দক্ষ ছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়স অব্দি অশ্বারোহণের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে যেতেন। (হিতকরী পাক্ষিক, ৩১ অক্টোবর ১৮৯০)


লালন ফকিরের মাজার, ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়া। ছবি. সুধীর চক্রবর্তী, ১৭ অক্টোবর ২০০১

লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘কাঙ্গাল হরিনাথ তাকে জানতেন, মীর মশাররফ তাকে চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিলো, লেখক রায় বাহাদুর জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাকে সামনাসামনি দেখেছেন, গান শুনেছেন, তবু জানতে পারেন নি লালনের জাত পরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।’ লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘মনের মানুষ’, ২০০৮, পৃ. ১৯৭)। লালন ছিলেন মানবতাবাদী বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ্, মহাত্মা লালন ফকির, বাউল সম্রাট বিভিন্ন উপাধিতে ভক্ত ও সুধী-সাধারণের মাঝে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক সাধক, বাউল ঘরানার মরমি সাধক, বাউল, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। লালনের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে, যা তার জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিলো। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘মহাত্মা লালন’ নিবন্ধে প্রথম লালন জীবনী রচয়িতা শ্রীবসন্ত কুমার পাল বলেছেন: ‘সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, এ কথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম।’ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, লালনের জীবদ্দশায় তাঁকে কোনো ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে দেখা যায় নি। নিজ সাধনা বলে তিনি হিন্দু ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিলো তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে বহু ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাধু বাউল এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির (আরবি ‘সাধু’) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন: ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

বাউলগান ইউনেস্কো কর্তৃক World Heritage (২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর) এর অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় লালন ফকিরের গান দেশ ও বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। মকছেদ আলী শাহ ও গোলাম ইয়াছিন শাহ্ সম্পাদিত দ্বিভাষিক ‘সেদিনের এইদিনে’ And this Day (১৯ মার্চ ১৯৮১) পুস্তিকায় মকছেদ আলী শাহ-কৃত লালনের কয়েকটি গানের অনুবাদ সংকলিত হয়েছে। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লালনের গান বিশ্লেষণ করে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে: ‘সবদিক দিয়া বিবেচনা করিলে বাউলগান রচয়িতা হিসাবে মুসলমান বাউল লালন ফকিরই সর্বশ্রেষ্ঠ। ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন: ‘শরীয়তবাদী মুসলমানগণ লালনকে ভালো চোখে কোনদিনই দেখেন নাই। এ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল লালনের খ্যাতি-প্রতিপত্তির দিনেও তাঁহাকে নিন্দা করিয়াছে।...এই বাউল-পন্থী নেড়ার ফকিরেরা চিরকাল...অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়াছে।’ অত:পর লালন সবিশেষ একটি গানে আক্ষেপ করে বলেছেন-
‘এ দেশেতে এই সুখ হলো, আবার কোথা যাই না জানি’...
মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলীতেও লালনের রচনা শৈলীর অনুকরণ দেখা যায়। তিনি After Lalon নামে একটি কবিতাও রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন তিনি লালনের ‘আছে যার মনের মানুষ সে মনে’ এই গানে উল্লেখিত মনের মানুষকে তা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গোরা’ শুরু হয়েছে লালনের গান দিয়ে-
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেম্নে আসে যায়’

লালন আখড়াবাড়িতে দৃষ্টিনন্দন একতারা

রবীন্দ্রনাথের পর দেশ-বিদেশে অনেকেই গবেষণা-লেখালেখি-সংগীতসাধনের মধ্য দিয়ে লালনকে সুপরিচিত করে তুলেছেন। বিদেশি গবেষকদের মধ্যে মার্কিন গবেষক ক্যারল সলোমনের (২৮ জুলাই ১৯৪৮-১৩ মার্চ ২০০৯) কর্মসাধনা অনন্য। শ্রেষ্ঠ বাউল সাধকশিল্পী লালনের টানে তাঁর বাংলাদেশে যাতায়াত শুরু। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে, বাউলের আখড়া-আসরে গমন করে বাউল গান শোনেন, তত্ত্বজ্ঞান নেওয়ার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের খ্যাতিমান বাউল-গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী থেকে শুরু করে তরুণ লোকগবেষক সাইমন জাকারিয়াসহ অনেকের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। প্রচুর অডিও-ভিডিও ও অন্যান্য মাধ্যমের প্রমাণাদি সংগ্রহসাপেক্ষে, বাংলা কথনে চৌকস ও বাঙালি পোশাকে অভ্যস্ত ক্যারল একসময় বাউল ও লালন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। বাউল বিষয়ে একাধিক রচনা ও লালনের কিছু গানের তরজমা করে জীবদ্দশায় ইউরোপ-আমেরিকায় বিশেষ পরিচিতি পান। তার আন্তরিক অভিপ্রায় ও প্রচেষ্টা ছিল লালনের গানের প্রামাণিক পাঠ তৈরি করে তা ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে লালনকে যথার্থভাবে তুলে ধরা। এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট এগিয়েছিলেন; প্রায় দেড়শত গানের পাঠ-নির্ণয় ও ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন করেন। কিন্তু তার বহু দিনের বহু শ্রমের যে স্বর্ণফসল, নিজে তা তুলে দিয়ে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লালনের গানের অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালনের গানের খাতা থেকে। তার অনুবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। কেননা ঈধৎড়ষ তাঁর অনুবাদের জন্য প্রামাণ্য লালনগীতি ব্যবহার করেছেন এবং বাউল-সাধনতত্ত্ব ও বাউলজীবন সম্বন্ধে তার রয়েছে প্রাজ্ঞ ধারণা ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। লালনের কথায় যে ব্যাকুলতা ও নিবেদন ভাষা পেয়েছে তা গানের মধ্যে লক্ষ্যণীয়:
‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না, দেখা দিয়ে ওহে রাছুল ছেড়ে যেও না’...

এমনিভাবে বিস্ময়কর বিবেচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে তিন দশক ধরে যেসব লালন সংগীতের পাঠ তিনি নির্ণয় করেছিলেন এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন সেগুলোর একশ সাইত্রিশটি গান নিয়ে সম্পূর্ণ বাংলা ও ইংরেজিতে দ্বিভাষিক সংকলন বের হয়েছে। বইটির নাম ‘লালন সাঁইজির গান 'City of Mirrors: Songs of Lalon Sai’। প্রকাশক আমেরিকার নিউইয়র্কের বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড ইউনিয়ন প্রেস। সম্পাদনা করেছেন ক্যারলের বাংলাদেশের বিশস্ত সহচর শ্রমনিষ্ঠ লোকগবেষক-লেখক-উপস্থাপক সাইমন জাকারিয়া ও আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়ান ওপেনশাও। আমরা মনে করি, পাশ্চাত্যে লালন নিয়ে যে আগ্রহ-উৎসাহ রয়েছে, তা পূরণে সংকলনটি অত্যন্ত সহায়ক হবে।’ অসমীয় ভাষায় অনুবাদ করেছেন মণিপুরি নৃত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি দেবযানী চহিলা (জন্ম ১৯৩৪) এবং ‘লালন সাঁইর গীত’ নামক গ্রন্থটির মূল্যবান ভূমিকা লিখে দিয়েছেন প্রখ্যাত লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী। ড. সনৎকুমার মিত্র ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে ‘লালন ফকির: কবি ও কাব্য’ নামক গ্রন্থে লালনের আসল প্রতিকৃতি বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। বাউলগান ও লালন ফকির নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা গবেষণা পুস্তক দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি বৎসর দুবার কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়াতে অনুষ্ঠিত লালন মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও বিদেশ থেকে গবেষক, মিডিয়া, টেলিভিশন ও ফিল্ম সভাসদের সমাবেশ ঘটে। এই সময় কুষ্টিয়া জেলা শহর এবং ছেঁউড়িয়া গ্রাম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসব প্রাঙ্গণে পরিগণিত হয়। মৃত্যুর বহু বছর পরেও লালন ফকিরের খ্যাতি আজ তুঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পরে এমন খ্যাতি এ দেশে অন্য কারো ভাগ্যে জোটেনি।

লালনকে নিয়ে যেসব গবেষণা এখন পর্যন্ত উপস্থিত ও অধীত, তা ব্যক্তি লালনকে অনেকখানি করেছে ধোঁয়াশামুক্ত। পূর্বসূরিদের লালন গবেষণার বিতর্কিত ও সংশয়িত বিষয়সমূহের খোলনলচে পাল্টে দিয়ে হাজির করেছেন যুক্তিসঙ্গত ও প্রশ্ননির্ভর বিবেচনাসমূহ। আহমদ শরীফ, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুধীর চক্রবর্তীর মতো বিদ্বজ্জনরা লালন বিষয়ক প্রবন্ধাদি মারফত লালন গবেষণায় যুক্ত করেছেন গতি ও নতুন অভিঘাত।” আমরা লালন রচিত প্রায় এক হাজার গানের সন্ধান পেয়েছি। এসব গান সংগ্রহের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ পথিকৃৎ। শ্রীবসন্তকুমার পাল, ‘হারামনি’ প্রণেতা মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, লালন গবেষক ম. মনিরউজ্জামান, মুহম্মদ আবু তালিব, ড. আনোয়ারুল করীম, খোন্দকার রিয়াজুল হক, শক্তিনাথ ঝা, ড. আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ প-িত-গবেষক প্রাণান্ত শ্রম-মেধা-মনন দিয়ে লালনের গানের একটি সমৃদ্ধ ভান্ডার গড়ে তুলেছেন। রণজিৎ কুমার লালন সম্পর্কে ‘সেনবাউল রাজারাম’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরেশ ভট্টাচার্য রচনা করেন ‘বাউল রাজার প্রেম’ নামে একটি উপন্যাস। ভারতের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের জীবনী নিয়ে রচনা করেন ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস। ১৯৩৬ সালে সুনির্মল বসু ‘লালন ফকিরের ভিটে’ নামে একটি ছোট গল্প রচনা করেন। শওকত ওসমান ১৯৬৪ সালে রচনা করেন ‘দুই মুসাফির’ নামের একটি ছোটগল্প। লালন সাঁইজির জীবনীর নির্ভরযোগ্য তথ্য ও লালন-দর্শনের মূল কথা নিয়ে ড. সাইমন জাকারিয়া রচনা করেছেন ‘উত্তরলালনচরিত’ শীর্ষক নাটক। লালনকে নিয়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেন ‘লালন ফকির’ চলচ্চিত্রটি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৮৬ সালে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ম. হামিদ ১৯৮৮ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র ‘দ্যাখে কয়জনা’ যা বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। তানভীর মোকাম্মেল ১৯৯৬ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র ‘অচিন পাখি’। ২০০৪ সালে তানভির মোকাম্মেলের পরিচালনায় ‘লালন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ চলচ্চিত্রটিতে লালনের ভূমিকায় অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ২০১০ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা ২০১০ সালে ৪১তম ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে। উল্লেখ্য যে, এই চলচ্চিত্রে লালনকে কোন উল্লেখযোগ্য সূত্র ছাড়াই হিন্দু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং চলচ্চিত্রটি অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। ২০১১ সালে মুক্তি পায় হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত ‘অন্ধ নিরাঙ্গম’ নামের চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রটিতে লালনের দর্শন ও বাউলদের জীবনযাপন তুলে ধরা হয়েছে। লালনের পদ লালনগীতি বা লালন সংগীত হিসেবে পরিচিত। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন একাই তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন যা তার হারামনি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। লালনের গানের কথা, সুর ও দর্শনকে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন ভাবে উল্লেখ করেছেন। লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন: ‘অনেক গান আছে যেখানে লালন বলে কথাটির উল্লেখ আছে, তার সবই প্রকৃতপক্ষে লালনের নয়।’ আলাউদ্দীন মন্টু শাহ নামের একজন বাউল তিন খণ্ডের একটি বই প্রকাশ করেছেন, যাতে তিনি পণ্ডিত মনিরুদ্দিন শাহ্ নামক লালনের সরাসরি শিষ্যের সংগৃহীত লালন সংগীতগুলো প্রকাশ করেছেন। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় ফকির লালন শাহ্ দুই হাজারেরও অধিক পদ বা গান রচনা করেছেন।

বাউলের সাধনা-দর্শন-সংগীতের প্রধান ব্যক্তিত্ব লালন সাঁইকে নিয়ে ভিন্ন-ভাষাভাষীদের মধ্যেও আগ্রহ-সন্ধিৎসার পরিচয় মেলে ক্যারল সলোমন, মাসাউকি ও’নিশি, মাসাহিকো তোগাওয়া, ম্যান্ড্রিন উইনিয়স, ব্রাদার জেমস্, ফাদার মারিনো রিগন, দেবযানী চলিহা এবং আরো কারো কারো রচনা ও অনুবাদে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক লোকগবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী এক আলোচনায় অংশ নেন। ঐ আলোচনা সভায় প্রায় আধ ঘন্টার বক্তৃতায় বিশিষ্ট কূটনৈতিক, সমালোচক ও গবেষক অধ্যাপক মুচকুন্দ দুবে লালন-প্রতিভার নানা দিক এবং তাঁর লালন-অনুবাদের প্রসঙ্গ ও তার তাৎপর্য বিবৃত করেন। তাঁর বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো ১. ‘অবিভক্ত ভারতের সাধু-কবিদের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম লালন। তিনি এক মহান সমাজসংস্কারক। বিভিন্ন ধর্মের ঐতিহ্যের মূল বাণী খুবই সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন লালন। আর তা মানুষের মনে অক্ষর দাগ রেখে গেছে। কেন হিন্দিভাষীরা এই মহামানবের অপূর্ব বাণী থেকে বঞ্চিত হবে? ২. ‘লালন জাত-পাত, বর্ণ-সম্প্রদায়, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ মানতেন না। আজকের পৃথিবীতে তিনি বিপুলভাবেই প্রাঙ্গিক। মানব প্রজাতি যে এক, আমাদের নিজ নিজ দীনতা বিষয়ে সচেতন হওয়া যে উচিত, লালনের এ ধরনের বার্তার জন্য আজকের দুনিয়া আকুল। পৃথিবী এ কথা শুনতে চায়।’ ৩. ‘সাহিত্যিক মূল্য ও সৃষ্টিশীল ভাবের সরল ও গভীর প্রকাশের অপার ক্ষমতা দেখিয়েছেন লালন। খুবই গভীর দর্শনে তিনি যে সারল্য প্রকাশ করেছেন, তা অনন্য। নিরক্ষর হলেও তিনি তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন। তিনি তাঁর জনগণের মুখের ভাষা, মাটির ভাষাতে রতেœর মতো সুন্দর ও অমূল্য করে তুলেছেন।’ ৪. ‘ভারতে লালনকে প্রয়োজন, ভারতের বৈচিত্র্যে বিভক্ত সমাজ লালনের জন্য অপেক্ষা করছে।’

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দিব্যদ্যুতি সরকার লালন সম্পর্কে বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি আর লালনের আখড়ার দূরত্ব ছিলো মাত্র ছয় মাইল, একজন শিলাইদহে অন্যজন ছেঁউড়িয়ায়। লালন রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসংগীতসহ কোনোটায় আগ্রহ বোধ করেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আগ্রহ বোধ করেছিলেন লালনের গানে। সেই আগ্রহের কারণে তিনি লালনের ২৯৮টি গান সংগ্রহও করেছিলেন। দৃশ্যত এই দুইজনের পৃথিবী ছিলো বিপুল ব্যবধানের। একজন ফকির, পথেঘাটে থাকেন। অন্যজন অভিজাত জমিদার, ক্ষণে ক্ষণে বাড়ি গাড়ি পাল্টান, পাল্টান বাড়ির নামও। একজন জীবদ্দশাতেই বিশ^ময় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। অন্যজন প্রাণপণে নিজেকে আড়ালে রাখতেন।’ লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক কাজল রশীদ শাহীন লালন সম্পর্কে লিখেছেন: “লালন (লালন মানে লালন সাঁই ও ওর গান) যেহেতু এখনও আমাদের মাঝে রয়েছে ডগমগে রূপে বিরাজিত, তাই বলা যেতেই পারে লালন আছেন এবং আমরা তাঁকে চিনেছি। সেই অর্থে অবশ্যই লালন আমাদের চেনা। একথা তো সত্যি, লালনের গান এখন ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে বেরিয়ে, নদীয়ার ভূগোল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। লালন এখন বাঙাল মুলুকে তো বটেই, বাঙালির বিশ্বঅভিবাসনের নিমিত্তে পৃথিবীব্যাপীই গেছে ছড়িয়ে। বেড়েছে লালনপ্রেমী গবেষক, শুভানুধ্যায়ী, অনুরাগীর সংখ্যা। দেশ বিভাজনের সীমারেখা ছাড়িয়ে, কাঁটাতার পেরিয়ে ওপারেও লালন খুঁজে ফিরছেন মনের মানুষ। সুমনকুমার দাশ (লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক) লালন সম্পর্কে লিখেছেন: ‘বাউলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে মানুষবন্দনার জয়গান। মানুষবন্দনার পাশাপাশি দেহতত্ত্ব ও সাধনসংক্রান্ত নিগৃঢ় তত্ত্বগুলোও তাঁদের গানে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে লালনের পদাবলি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে।’ লেখক ও গবেষক সিরাজ প্রামাণিক (আইনগ্রন্থ প্রণেতা, সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’) লালন সম্পর্কে বলেছেন মানবধর্মের কথা, অমৃতের সন্ধান করেছেন আত্মজ্ঞানের মধ্য দিয়ে। আজ সেই অমৃতের সন্ধানেই সাঁইজির ধামে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী, অনুসারীরা ছুটে আসেন। বাঙালির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান লালন আজ বিশ^সমাজের মহান আদর্শ, মানবতাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে লালন আজ মহান আইকন।

‘মহাভারতের সমাজ’ নিয়ে সুখময় শাস্ত্রীর যে অভিধানিক অবদান তার নেপথ্যে তো ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। একারণেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা যে রবীন্দ্রনাথ লালনের গানের খাতা সংগ্রহ করেছিলেন, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লালনের গান প্রকাশ করেছিলেন, হিবার্ট বক্তৃতায় লালনকে উল্লেখ ও মূল্যায়ন করেছিলেন। এতদ্বিধ ঋণ স্বীকার ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেও বলতে হয় তার প্রযত্ন ও দিকনির্দেশনায় লালনকে চেনার জন্য যদি কেউ নিবিষ্ট হতেন, তা’হলে হয়তো আজকে আর লালন ততোটা অচেনা থাকতো না, যতোটা রয়েছে আজও। ফকির লালন শাহ্ কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালীন তার বিচিত্রতা লক্ষণীয়! বিশিষ্ট লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ গ্রন্থে (‘মহাত্মা লালন ফকীর’ পাক্ষিক ‘হিতকরী’, ১ম ভাগ, ১৩শ সংখ্যা, ১৫ কার্তিক ১২৯৭, ৩১ অক্টোবর ১৮৯০) উল্লেখ কাহিনির বর্ণনায় নিবন্ধকার রাইচরণ দাসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন: 'ইনি ১১৬ বৎসর বয়সে গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন।...মরণের পূর্ব্বে রাত্রিতেও প্রায় সমস্ত সময় গান করিয়া রাত্রি ৫টার সময় শিষ্যগণকে বলেন ‘আমি চলিলাম’।...লালনভক্ত অনুসারীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার গান ও দর্শন সমগ্র বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলার বাউলের প্রাণপুরুষ মহাত্মা লালন নিয়ে গবেষণা থেমে নেই। যুগে যুগে লালন গবেষণার পরিধি কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ায় লালন একাডেমি থেকে বের হয়ে তামাম পৃথিবীর লালন বিশেষজ্ঞ ও আপামর মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

 

লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক

Header Ad
Header Ad

পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে চিতা বাঘের অস্তিত্বের নতুন প্রমাণ

ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে আবারও দেখা মিলেছে চিতা বাঘের। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা সংস্থা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ) সম্প্রতি বান্দরবানের একটি সংরক্ষিত বনে ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে এশিয়াটিক প্রজাতির একটি চিতাবাঘের ছবি ধারণ করেছে। চলতি জুন মাসেই স্থাপিত ক্যামেরায় এই বিরল প্রাণীটি ধরা পড়ে, যা দীর্ঘদিনের ধারণার বাস্তব ভিত্তি দিল।

এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমিতে এখনও চিতা বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ১৯০৬ সালের একটি রেকর্ডে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী অববাহিকার বনে চিতা বাঘের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়েও এই বিরল প্রাণীকে ক্যামেরায় ধরা পড়তে দেখা গেছে।

সিসিএ প্রধান নির্বাহী শাহরিয়ার সিজার জানিয়েছেন, প্রাণীটির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সঠিক অবস্থান গোপন রাখা হয়েছে, যাতে কোনো শিকারি এর ক্ষতি করতে না পারে। তিনি আরও জানান, ২০১৫ সালেও পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি চিতা বাঘের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছিল, তবে বর্তমানে সংখ্যাটি আরও হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান এই আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, অঞ্চলটি চিতাবাঘের প্রজনন ও বিচরণের জন্য উপযুক্ত হলেও শিকারি ও বন উজাড়ের মতো হুমকিগুলো এর অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে গবেষকরা ধারণকৃত চিতাবাঘটির লিঙ্গ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণে কাজ করছেন।

এই আবিষ্কার বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দিক থেকে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে, বলেও মনে করছেন গবেষকরা।

Header Ad
Header Ad

আজ থেকে শুরু এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা

ছবি: সংগৃহীত

আজ বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) থেকে শুরু হলো ২০২৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। সকাল ১০টায় বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার মাধ্যমে শুরু হয় লিখিত পরীক্ষা, যা চলবে আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর ১১ থেকে ২১ আগস্টের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে ব্যবহারিক পরীক্ষা।

এ বছর নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন। তবে গত বছরের তুলনায় এবার পরীক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৮১ হাজার।

উল্লেখযোগ্যভাবে, দুই বছর আগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হলেও রেজিস্ট্রেশন করা চার লাখের বেশি শিক্ষার্থী এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন না।

চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন আলিম পরীক্ষার্থী ৮৬ হাজার এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে রয়েছে ১ লাখ ৯ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী।

সারা দেশে মোট ২ হাজার ৭৯৭টি কেন্দ্রে একযোগে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষা বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস রোধসহ নকলমুক্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

 
 
Header Ad
Header Ad

২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ!

ছবি: সংগৃহীত

২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে এই উত্তরণের চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিয়েছে। এটি দেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অর্জন শুধু কাগজে-কলমে মর্যাদা হলেও বাস্তবে মানুষের জীবনে বড় সুবিধা নাও আনতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের কাঠামোগত দুর্বলতা, আয় বৈষম্য, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এই মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সুবিধাও হারাতে চলেছে বাংলাদেশ। যেমন— ইউরোপ, কানাডা ও জাপানে রপ্তানিতে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ছিল, তা আর থাকবে না। এতে তৈরি পোশাক খাতসহ অন্যান্য রপ্তানিতে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতনির্ভর। এই একমুখী নির্ভরতা, অনির্দিষ্ট শুল্কনীতি, শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতার ঘাটতি, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

অন্যদিকে, মানুষের জীবনমান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যদিও মাথাপিছু আয় বেড়ে ২৮২০ ডলারে পৌঁছেছে, বাস্তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান অনেক বেড়েছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।

তবে সরকার বলছে, ‘সুশৃঙ্খল উত্তরণ কৌশল’ গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় নতুন বাজার খোঁজা, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সম্প্রতি একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় সিঙ্গেল উইন্ডোর বাস্তবায়ন, শুল্ক নীতি কার্যকর করা, সাভারের ট্যানারি ভিলেজে ইটিপি স্থাপন, গজারিয়ায় এপিআই পার্ক চালু এবং অবকাঠামো উন্নয়ন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সবচেয়ে জরুরি হলো এই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। না হলে বাংলাদেশের এই উত্তরণ কেবল একটি ‘মর্যাদার সার্টিফিকেট’ হয়েই থাকবে। মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে এখনই কার্যকর ও সমন্বিত প্রস্তুতি দরকার।

Header Ad
Header Ad

সর্বশেষ সংবাদ

পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে চিতা বাঘের অস্তিত্বের নতুন প্রমাণ
আজ থেকে শুরু এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা
২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ!
১৬ জুলাই ‘শহীদ আবু সাঈদ’, ৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ’ দিবস ঘোষণা
জার্মানি বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার: প্রধান উপদেষ্টা
ইসরায়েলে আবারও ড্রোন হামলা
এবার ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায় ছাত্রলীগ নেতার নাম!
দেশে আজ ২৬ জনের করোনা শনাক্ত
ইরান-ইসরায়েল বাচ্চাদের মতো মারামারি করছিল, আমি থামিয়েছি : ট্রাম্প
স্ত্রীকে হত্যা: ‘অপারেশন সিঁদুরে’ অংশ নেয়ায় দায়মুক্তি চান ভারতীয় কমান্ডো!
মুক্তিযুদ্ধসহ অতীতের সব ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন জামায়াতের আমির
নীলফামারীতে বিএনপির সদস্য সংগ্রহের দায়িত্বে সাইদুর রহমান রয়েল
হাসিনার সেই ‘৪০০ কোটি টাকার’ পিয়নের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-সঞ্চয়পত্র ফ্রিজ
আশুরা ও রথযাত্রা উপলক্ষে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে: ডিএমপি কমিশনার
যমুনা সেতু মহাসড়কে ৫৯ লাখ টাকার মালামালসহ ট্রাক ডাকাতি, গ্রেফতার ২
‘প্রজাপতি ২’ থেকে ফারিণকে বাদ, দেবের বিপরীতে নতুন মুখ
ডেঙ্গুতে একদিনে আরও দুইজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩২৬ জন
সাবেক গভর্নর কুমোর হার, নিউইয়র্কের সম্ভাব্য মেয়র মুসলিম তরুণ মামদানি
ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগে ওসি মাসুদ এখন এসআই
চিত্রনায়ক নাঈমের দাবি মেনে নিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ