সারাদেশ

'সব বন্যায় লুইয়া গেছেগি, অনাহারে মরতাছি'


প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ
প্রকাশ :২৩ জুন ২০২২, ০২:০৪ এএম

'সব বন্যায় লুইয়া গেছেগি, অনাহারে মরতাছি'

ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলাই। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। পানিবন্দী অবস্থায় না খেয়েই দিন পার করছেন লাখো মানুষ। তাদের একজন সাহেদা বেগম। সুনামগঞ্জের পৌরশহরের ইকবালনগর এলাকার বাসিন্দা তিনি। বন্যায় তার ঘরবাড়ি ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রাণ রক্ষায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেন তিনি।

বুধবার (২২ জুন) সুনামগঞ্জ পৌর ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ বসতঘরে মাটির চুলা ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে ফিরছিলেন। এসময় ক্লান্ত শরীরে সড়কের এক পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসেছিলেন। সেসময় কথা হয় সাহেদা বেগমের সাথে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম আর চোখের পানি মুছতে মুছতে সাহেদা বেগম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বন্যার পানি আইছে, আমরা বুক পানির মধ্যে আসলাম। মরি জাই মরি জাই অবস্থায় আসলাম। কোনো রকম নিজের জানটা বাঁচাইছি। আমরা একটা সুতা পর্যন্তও সাথে লুইয়া আইতে পারছি না। ঘরবাড়ি যা আছিল সব বন্যায় লুইয়া গেছেগি। পরে আমরা এইকানো (সুনামগঞ্জ পৌর ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্র) আশ্রয় লুইছি, ইকানো খানিবনি (খাবার) নাই, এখন আমরা অনাহারে মরতাছি। ইকানো চুলা নাই, রানবার (রান্না) কোনো সিস্টেম নাই, বাচাকাচ্চা লুইয়া মহা মছিবতে আছি। আজকে ছয়দিন এক কাপড় পইরা আছি।

এক প্রশ্নের জবাবে সাহেদা বেগম বলেন, একদিন মাত্র এক ফুতলা চিড়া পাইছলাম। এই চিড়া ভিজাইয়া ভিজাইয়া খাইয়া জান রক্ষা করলাম। আমরা কোনো ত্রাণ পাইছি না, আজকে ছয়দিন থাকি উপোস, ভাত মাছ চোখেই দেখছি না। সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইছি না।

শুধু তিনি একা নেন, তার মত লাখো মানুষ না খেয়েই দিন পার করছেন। সুনামগঞ্জ পৌরশহরের নবী নগর এলাকার বাসিন্দা আয়শা বেগম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গত কয়দিন থেকে আমরা খুবই কষ্টতে আছি। আমরা কাঁঠাল, কলা খাইয়া বাইচ্ছা আছি, আমরা চিড়া মুড়িও পাইছি না। বর্তমানে নিরাপদ পানির অভাবে ভাতের কষ্টে আছি। এখন আমার ঘরের চাল পানিতে ডুবাইল, আমরার সব ক্ষতিগ্রস্ত হইছে। সরকারের কাছে আমার দাবি আমরা বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি যারা হইছি তাদের পায়ের নিচে একটু মাটি আর মাথার ওপরে একটু ছেবা আর একটু খাওন যেন দেয়।

এদিকে বন্যার্ত মানুষের পাশে সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তার অপ্রতুলে অভিযোগ থাকলেও পানিবন্দীদের পাশে দাঁড়িয়েছে নানা সংগঠন। এক টানা কয়দিন থেকেই ষোলঘর‍ যুব সংঘের সদস্যরা নিজেরা রান্না করে ভুনা খিচুড়ি আশ্রয়কেন্দ্রে বিতরণ করছেন। এসময় ষোলঘর যুব সংঘের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন পীর বলেন, চারদিকে এত পানি, মানুষ না খেয়ে উপোস আছে দেখে আমরা বসে থাকতে পারিনি। আজ পানির জন্য অসহায় দরিদ্র মানুষরা স্কুলে উঠছে, তাদের খাবার নাই, আমরা তাদের খাবার দিয়েছি। আরও রান্নার কাজ চলছে, আরও বিতরণ করব। আমি সমাজের সবল মানুষদের কাছে অনুরোধ জানাই সবাই এগিয়ে আসুন।

সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলাতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকটে পড়েছেন সুনামগঞ্জবাসী। খাবারের জন্য দেখা দিয়েছে হাহাকার। জেলার বেশিরভাগ বাজারের সকল দোকানপাট বন্ধ থাকায় খাবারের সন্ধানে ছোট নৌকা ও হেঁটেই বের হচ্ছেন অসহায় মানুষগুলো। অনেকে বাজারে কোনো খাবার না পেয়ে ছেলে মেয়ের পেটের ক্ষুধা মেটাতে কাঁঠাল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে দ্বিগুণ দামে কলা, বিস্কুট কিনে রাস্তায় বসে খাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

তবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বন্যার্ত মানুষের মাঝে আমরা সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছি। বানভাসি মানুষের মধ্যে প্রতিদিন ১০ হাজার প্যাকেট রান্না করা খাবার বিতরণ হচ্ছে। উপজেলায় একই ধরনের উদ্যোগ আছে। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। শুকনো খাবার নৌপথে অনেক জেলা থেকে এসেছে। আরও পথে আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বন্যাকবলিত মানুষদের উদ্ধার এবং খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে।

এসজি/