পাঠকের কথা

নারীদের জন্য উৎসর্গ করা একটি দিন


ঢাকাপ্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশ :০৮ মার্চ ২০২২, ০৪:২০ এএম

নারীদের জন্য উৎসর্গ করা একটি দিন

চিরায়ত আগল ভেঙে বহ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠুক নারী। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে অঙ্গীকারে দীপ্র হোক। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছর ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। আজ নারীদের জন্য উৎসর্গ করা একটি দিন।

এ বছরের নারী দিবসে জাতিসংঘের স্লোগান ‘নারীর সমতা সকলের’। নারীর প্রতি সব রকম বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীর এগিয়ে চলা আরও বেগবান হোক। এ দিবসটি এক শতাব্দী-প্রাচীন আন্তর্জাতিক দিবস।

বিশ্বে সেবারই প্রথম নারী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমে আসে প্রায় ১৫ হাজার নারী। নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে রাস্তায় নেমে মিছিল করেন। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল নারীর মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।

বলছি, ১৬৪ বছর আগের কথা। ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মিছিলে চলে সরকারের লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজন করে হয় নারী সমাবেশ। সেখানে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো।

ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা।

১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে শুরু করে। এরপর জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে হয়। এমনকি দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে পুরো পৃথিবী জুড়েই নারীর সমঅধিকার আদায়ের দাবিতে পালিত হচ্ছে দিনটি। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই নারীর প্রতি সম্মান জানাতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির দিন পালন করা হয়।

এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান, ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া এবং জাম্বিয়া। এছাড়াও চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারী ছুটির দিন উপভোগ করে থাকেন।

নারী দিবসের প্রথম প্রতিপাদ্য ছিল অতীত উদযাপন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। যেটি ছিল ১৯৯৬ সাল। এরপর থেকে প্রতি বছর একেকটি প্রতিপাদ্য নিয়ে পালন করা হয় নারী দিবস। প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে নারী দিবস পালিত হলেও বিশ্বজুড়ে নারীর অবস্থানে খুব একটা তারতম্য চোখে পড়েনা। আর প্রতিবছরই নারী দিবস নারীদের হাজার বছর ধরে বঞ্চনার ইতিহাস সামনে নিয়ে আসে।

একদিকে বৈপ্লবিক রূপান্তর ছাড়া নারী প্রশ্নের সমাধান সম্ভব নয়, অন্যদিকে নারী প্রশ্নকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা ছাড়া সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর, এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কার্যকর বিকাশও সম্ভব নয়। (আনু মুহাম্মদ; নারী, পুরুষ ও সমাজ; পৃষ্ঠা: ১৫০)। সুতরাং সমাজ কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিপরীতে আমরা যতই স্লোগান তুলি না কেন, তার দ্বারা নারীমুক্তির বিষয়টি অধরাই থেকে যাবে।

এ অবস্থায় একটি প্রাসঙ্গিক উপসংহার সামনে চলে আসে। অনেকেই মনে করেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ঘিরেই যেহেতু নারী-পুরুষ বৈষম্যের সৃষ্টি, সেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘটালেই নারী স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে যাবেন। এ ধারণাটি অমূলক না হলেও অসম্পূর্ণ। কেননা নারীর প্রতি ভোগবাদী এবং করুণার দৃষ্টিভঙ্গি অতি প্রাচীন এবং তা সমাজের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। এটি একদিনেই মিলিয়ে যাওয়ার মতো নয়। এর জন্য চাই দীর্ঘ সময় ধরে একটি সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যা সমাজ থেকে নারীর প্রতি অপদৃষ্টি দূর করতে সক্ষম হবে। এর বাইরে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ প্রথম পালিত হয় নারী দিবস। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তজার্তিক স্বীকৃতি পায় নারী দিবস। এরপর থেকেই এ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

জগত সংসারে নারীকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। নিজের সন্তানকে জন্ম ধারণ এবং জন্ম দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখানোর মাধ্যমে একজন মা নারী হিসেবে জীবনের সার্থকতা লাভ করে। যখন একটি শিশুর জন্ম হয় তখন একটি মায়েরও জন্ম হয়। এ ছাড়া স্ত্রী, বোন, কন্যাসহ মর্যাদাপূর্ণ সব সম্পর্কের বাঁধনে নারীরা সমাজের সঙ্গে আবদ্ধ। তারা সমাজের অর্ধেক অংশ। তাদের প্রতিভা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। আন্তর্জাতিক নারী দিবস যেন একটি দিনের জন্য না হয়; বরং প্রতিদিন হোক নারীর জন্য, নারীর অধিকার আর উপযুক্ত সম্মানের জন্য।

ফিরোজ কবির: প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্রাঞ্চ, ঢাকা

এসএ/

পাঠকের কথা নিয়ে আরও পড়ুন