চলন্ত ট্রেনের দরজা দিয়ে ধাক্কা, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে যা বললেন মতিউর (ভিডিও)

ভুক্তভোগী মতিউর রহমান। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
পূর্ব বিরোধের জের ধরে মোবাইল চোর আখ্যা দিয়ে ট্রেনের কামরায় মারধর করা হয় আদম ব্যবসায়ী মতিউর রহমানকে (৪০)। পরে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান মতিউর রহমান। সেদিন তার সঙ্গে ট্রেনে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে ঢাকাপ্রকাশের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে আহত মতিউর রহমান বর্তমানে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পাড়ইল ফকিরপাড়া গ্রামের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মঙ্গলবার (২০ মে) দুপুর ১২টার দিকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক।
গত রোববার বগুড়া থেকে ছেড়ে আসা সান্তাহারগামী ট্রেনে তার সঙ্গে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে মতিউর রহমান বলেন, 'গত শনিবার বগুড়ায় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পরদিন রোববার মেয়ের বাসা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফেরার জন্য ১১টার দিকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে যাই। স্টেশনে চা খাওয়ার সময় মাস্ক পরা দুই যুবক আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ১২টার দিকে আমার ট্রেন আসলে আমি ট্রেনের যে বগিতে (কামরা) উঠি তারাও আমাকে অনুসরণ করে সেই বগিতে উঠে। সেদিন ট্রেনে তেমন ভিড় ছিল না। ট্রেন তালোড়া স্টেশন আসলে অনেক যাত্রী নেমে পড়ায় ওই বগি আরও ফাঁকা হয়ে যায়। কিছু দূর যাওয়ার পরে মাস্ক পরা দুই যুবক আমার পাশে এসে বসে। তারা আমার কাছ থেকে আমার বাসার ঠিকানা এবং অন্যান্য বিষয় জানতে চায়। আমিও তাদেরকে সেগুলোর উত্তর দেই। এরপর তারা আমার কাছ থেকে চলে যায়।'
মতিউর রহমান আরও বলেন, 'তখনও বুঝতে পারিনি ওরা আমাকে মারার জন্য ফলো করছে। ট্রেন আলতাফনগর স্টেশন থামলে সেখানে মাস্ক-পরা আরও পাঁচ যুবক আমাদের বগিতে উঠে। ট্রেন আলতাফনগর ছাড়ার পর সাত যুবক আমাকে মারতে শুরু করে। ট্রেনের অন্য লোকজন কেন মারছে জানতে চাইলে, ওরা বলে আমি নাকি ওদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল চুরি করেছি।' ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে একজনের মুখের মাস্ক আমি টান মেরে খুলি ফেলি। ওকে চিনে ফেলায় ওরা সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে মেরে ফেলবে। প্রথমে আমাকে মারার জন্য চাকু বের করে। পরে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে মারবে। একপর্যায়ে তারা আমাকে চাকু মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিতে চায়। তাদের মধ্যে থাকা একজন তখন বলেন, চাকু মারলে আমরা ফেঁসে যাব, একে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই তাহলে মানুষ ভাববে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। এ বলে তারা আমাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন আমি ট্রেনের দরজার রড ধরে ঝুলে বাঁচার চেষ্টা করি। এ সময় তাঁরা আমাকে চলন্ত ট্রেন ফেলে দেওয়ার জন্য ধাক্কা দিতে থাকে। এভাবে আলতাফনগর স্টেশন থেকে নশরতপুর পর্যন্ত প্রায় ৪-৫ মিনিট আমি ঝুলে ছিলাম।'
তিনি আরও বলেন, 'ট্রেন নশরতপুর স্টেশনে পৌঁছালে আমি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ট্রেনের নিচে পড়ে যাই। স্টেশনে থাকা লোকজন আমাকে কুঁজো হয়ে থাকতে বলেন। আমি তাদের কথা শুনে তখন সেভাবেই থাকি। আল্লাহর রহমতে কোনো রকমভাবে প্রাণে বেঁচে যাই। ট্রেন পড়ে গিয়ে আমার পিঠ ও পায়ের অনেক জায়গা ছিলে গেছে। আহত হয়ে আমার অবস্থা মৃতপ্রায়। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। খবর পেয়ে আমার স্ত্রী-সন্তানেরা এসে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।'
মতিউরের অভিযোগ করে বলেন, ‘ট্রেনে মারধর করা একজনকে চিনতে পেরেছেন তিনি। তার নাম সুমন (৩০)। তিনি আদমদীঘি উপজেলার দহরপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। সুমনের দুলাভাই আদমদিঘীর তালসন গ্রামের সজিব আমার মাধ্যমে সৌদি আরবে গেছেন। সজিবকে সৌদি আরবে গিয়ে কাজ পেতে সমস্যা হওয়ায় তার পরিবার আমাকে দোষারোপ করে আসতেছে। এই বিরোধের জেরেই সজিবের শ্যালক সুমনের নেতৃত্বে চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাকে ট্রেন মারধর ও পরে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
গত রোববার দুপুরে সান্তাহারগামী চলন্ত ট্রেনে মতিউর রহমানের ট্রেনে ঝুলে থাকা ও ট্রেন পড়ে যাওয়ার ৩৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ঘটনা নিয়ে গতকাল সোমবার ঢাকাপ্রকাশ অনলাইনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চাইলে সৌদি প্রবাসী সজিবের বাবা হেলাল উদ্দিন বলেন, হেলালের যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘৪০ দিন আগে সজীবকে মতিউরের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমার ছেলে কাজের সুযোগ পায়নি। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি। সে আমার সঙ্গে দেখা না করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। সাত থেকে আট দিন আগে তার বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম ছেলের বিষয়ে জানতে, তবে সেখানে কোনো ঝামেলা হয়নি। রোববার মতিউরের সাথে ট্রেনে কি ঘটেছে এর সাথে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নাই।'
ট্রেনে মারধর ও চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় মতিউর রহমান নিজে বাদী হয়ে গতকাল সন্ধ্যায় সান্তাহার জাংশন জি আর পি রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন।
এ বিষয়ে সান্তাহার রেলওয়ে থানা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, রোববারের ঘটনার পর গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে মতিউর এবং তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন। তাঁরা থানায় এসে আদমদিঘী উপজেলার দহরপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ সুমন ও অজ্ঞাত ৬-৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগটি গ্রহণ করে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য আদমদিঘী থানা পুলিশের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
