শৃঙ্খলাভঙ্গ করলে সরকারি চাকরিজীবীদের দ্রুত বরখাস্তের বিধান আনছে সরকার

ছবি: সংগৃহীত
সরকারি চাকরিজীবীদের শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দ্রুত বরখাস্তের বিধান যুক্ত করে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশোধিত আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্বে অবহেলা বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সর্বোচ্চ ২৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সংশোধিত আইনের খসড়া ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত হয়েছে এবং তা শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে এবং শৃঙ্খলাজনিত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে একটি সুশৃঙ্খল শাস্তিমূলক কাঠামো চালু করা হচ্ছে। বর্তমানে কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়, যা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ধীরগতির জন্যই ঘটে। তবে সংশোধিত আইনে এসব প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত করে অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ২৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।
নতুন বিধান অনুযায়ী, অভিযোগ প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সাত কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব দেবেন। এরপর অভিযোগ তদন্ত ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সর্বোচ্চ ২০ কার্যদিবস সময় থাকবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব না এলে, তা গ্রহণ না করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
সংশোধিত আইনে সরকারি দপ্তরে সভা-সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি, কর্মবিরতি, ধর্মঘট এবং বলপ্রয়োগসহ সব ধরনের দলবদ্ধ কর্মসূচিকে শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এমনকি কেউ এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতে অন্যকে প্ররোচিত করলেও তিনি একই শাস্তির আওতায় পড়বেন। কর্মস্থলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত থাকলেও তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুযোগ থাকবে।
জনপ্রশাসনের একাংশের বিরুদ্ধে সরকারি নিয়ম-নীতিকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগও উঠেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন কর্মকর্তার আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু কর্মকর্তা দলবদ্ধভাবে জনপ্রশাসন সচিবকে অবরুদ্ধ করে নিজেদের পছন্দমতো নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি আদায় করেছেন। এছাড়া ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব, কর্মবিরতি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন মন্তব্যের ঘটনাও ঘটেছে।
এসব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মনে করছে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং ভবিষ্যতে আন্দোলন বা বিক্ষোভের মতো কর্মসূচিকে নিরুৎসাহিত করতে কঠোর বিধান প্রয়োজন।
আইনের খসড়াটি প্রণয়নের সময় সরকার জনমত নেয়নি। সচরাচর কোনো আইন প্রণয়নের আগে তা জনসমক্ষে এনে মতামত আহ্বান করা হলেও এবার তা গোপনীয়ভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আইনের খসড়া প্রকাশ পেলে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চারজন উপদেষ্টার মতামত নিতে আলোচনায় বসে। উপদেষ্টারা হলেন—খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং গৃহায়ণ উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। ১৬ মে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপদেষ্টারা সংশোধনী খসড়া পর্যালোচনা করে মৌখিক ও লিখিত মতামত দেন। তাদের পরামর্শের ভিত্তিতেই খসড়াটি পুনরায় সংশোধন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ১৯৭৯ সালের ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ’ পুনর্বহালের সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। তারা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কর্মকর্তা আইনানুগ নির্দেশ মানতে অনীহা দেখাচ্ছেন, যার ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
তবে উপদেষ্টা পরিষদ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করছেন, সময়োপযোগী নয় এমন পুরনো আইন ফিরিয়ে আনার চেয়ে ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের মাধ্যমেই কার্যকর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত।
সরকারি চাকরিজীবীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম গতিশীল করতে দ্রুত বরখাস্তের বিধান যুক্ত করে নতুন আইন সংশোধনের পথে সরকার। যদিও এটি নিয়ে জনমত নেওয়া হয়নি, তবুও প্রশাসনিক অচলাবস্থা রোধ, দায়িত্বে অবহেলা রোধ এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন দেখার বিষয়—এই আইন কতটা বাস্তবসম্মতভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় এবং এর মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুফল অর্জিত হয় কি না।
