ব্যবসা বন্ধ, ঋণে সর্বস্বান্ত সিলেটের পাথর ব্যবসায়ীরা

সিলেটের পাথর ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ রয়েছে চার বছর ধরে। কিন্তু বন্ধ নেই ঋণের কিস্তি দেওয়া। পথে বসার উপক্রম পাথর ব্যবসায়ীদের। দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন এর সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়েছে দাঁড়িয়েছে বিদেশ থেকে ভাঙা পাথর আমদানি।
চার বছর ধরে একের পর এক দুশ্চিন্তা ভর করছে পাথর রাজ্যে। পাথরব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পাথরনির্ভর ব্যবসা স্টোন ক্রাশার মালিক- অনেকেরই এখন পথে বসার উপক্রম। পাথর ব্যবসা ও স্টোন ক্রাশার মিলে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়েছিলেন ব্যাংক থেকে। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও থেমে থাকেনি ঋণের সুদ দেওয়া। ঋণের ভারে সর্বস্বান্ত অনেক ব্যবসায়ী।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, শ্রীপুরসহ প্রায় ১০-১২টি পাথর খনি রয়েছে। যেখান থেকে দেশের চাহিদা মেটাতে ১ কোটি টন পাথর উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে সিলেট অঞ্চলের সবকটি কোয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে পাথর উত্তোলন। এর ফলে কোয়ারিনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এ ছাড়া কোয়ারিনির্ভর লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। অধিকাংশ পাথর ব্যবসায়ী কোয়ারি লিজ গ্রহণের পাশাপাশি স্টোন ক্রাশার মিলও গড়ে তোলেন। কিন্তু সরকারি নির্দেশে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় বন্ধ হয়ে যায় মিলগুলোও। এই অবস্থায় পাথর আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হলে ফের চাঙ্গা হতে থাকে পাথর ব্যবসা। আমদানি করা পাথর ভাঙার (প্রক্রিয়াজাতকরণ) সুযোগ পেয়ে ফের সচল হয়ে উঠে মিলগুলো। কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়েনি ব্যবসায়ীদের। নতুন আতঙ্ক এখন ভারত থেকে ভাঙা পাথর আমদানি নিয়ে। ভাঙা পাথর আমদানি অব্যাহত থাকলে ফের আর্থিক সঙ্কটে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। ফলে মাথায় হাত মিল মালিকদের।
এদিকে গত ৩১ মে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাথর কোয়ারি, পাথর উত্তোলন, খাস আদায় ও জব্দ করা পাথর উন্মুক্ত নিলামের বিষয়ে দায়ের করা মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সভায় গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি সমূহ আবার ইজারা দেওয়ার যোগ্য কি না তা যাচাই করার লক্ষ্যে জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সমূহের ১০ জন প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
তারা মজুদ পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনযোগ্য পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনের সময়কাল, পাথর কোয়ারি এলাকার পরিবেশ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ বিবেচনা করে পাথর কোয়ারি সমূহের হালনাগাদ করবেন। এ ছাড়াও খনি ও খনিজ সম্পদ আইন ১৯৯২ এবং খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা ২০১২ পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক সংশোধনের প্রয়োজন হলে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতেও বলা হয়েছে এই কমিটিকে। কিন্তু দুই মাস পরও ওই কমিটির কোনো প্রস্তাবনা বা সংশোধনী প্রস্তাব এখনও প্রকাশ করা হয়নি। ফলে শিগগিরই আলো দেখছেন না পাথর ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, সিলেটের ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের পাথর খনিগুলো বন্ধ থাকায় আমদানি করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। ইটের খোয়া থেকে পাথরের গুণগত মান ভালো থাকায় বেড়েছে এর আমদানির পরিমাণ। আমদানিতে যুক্ত হয়েছে দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী। দশকের ঘর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে সহস্র কোটি টাকার ঘরে উত্তীর্ণ হয়েছে পাথর আমদানির পরিমাণ। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাথর আমদানি। পণ্যভিত্তিক আমদানির প্রবৃদ্ধির হিসেবে পাথর উঠে এসেছে শীর্ষে। বিদেশ থেকে পাথর আমদানির কারণে কোটি কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এর ফলে চাপ পড়ছে বৈদেশিক রিজার্ভের উপর। বাড়ছে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম। কিন্তু দেশের বড় বড় খনি থেকে পাথর উত্তোলন করতে পারলে আমদানির পরিমাণ কমে আসত। চাপ কমত রিজার্ভের উপর থেকে। ব্যয় কমে আসত বড় বড় প্রকল্পসমূহের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জ পাথর খনি চালু অবস্থায় প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ ফিট পাথর সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। সে সময়ে সরকারি হিসাবে ৪৮ টাকা দরে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার পাথর সংগ্রহ হতো। তবে বেসরকারিভাবে এই আস্ত পাথর বিক্রি হতো ৮০-৮৫ টাকায়। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের দোহাই দিয়ে দেশের পাথর খনি বন্ধ করে আবার বিদেশের পাহাড় কেটে আমদানি হচ্ছে পাথর। বর্তমানে দেশের পাথরের চাহিদার বেশিরভাগ অংশ যোগান দিচ্ছে ভারত। তাদের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ পাথর আমদানি করছে বাংলাদেশ। এর বাইরে রয়েছে দুবাই, ভিয়েতনাম ও ভুটান।
পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালের আগে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ছয়টি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ও ভুটান থেকে পাথর আমদানি করতেন। এ সময় বছরে পাথর আসত মাত্র ৬০ কোটি টাকার। যখন পাথরের বাজার বড় হতে শুরু করে, তখন জড়িয়ে যায় বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী। গত তিন বছর থেকে তারা পাথর আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ অন্যতম। সাগর ও নদীপথে নিজেদের জাহাজ ব্যবহার করে বিদেশ থেকে সরাসরি পাথর নিয়ে আসছে তারা। এ গ্রুপগুলো যুক্ত হওয়ার পর গত ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে পাথর আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। যার বাজার মূল্য ৯ হাজার কোটি টাকা। তাতেই পণ্যভিত্তিক আমদানির প্রবৃদ্ধি বা বাজারের আকার হিসেবে পাথর উঠে এসেছে শীর্ষে। তবে আমদানি নির্ভরতা ও খরচ কমাতে হলে দেশীয় খনি থেকেই পাথর সংগ্রহে নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, এটি করা হলে, পাথর ক্রয়ে খরচ কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সিলেটে আমদানিনির্ভর পাথর ব্যবসা চললেও সম্প্রতি নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মিল মালিকরা। তাদের অভিযোগ, কিছু আমদানিকারক জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে কুশিয়ারা নদী পথে জাহাজ দিয়ে ভাঙা পাথর আমদানি করছেন। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি মিল মালিকদের ব্যবসাও বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল জলিল মেম্বার বলেন, বিদেশ থেকে পাথর আমদানির কারণে পাথরের দাম বেড়েছে। এ ছাড়াও রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছে। দেশীয় খনি থেকে পাথর সংগ্রহ করলে পাথরের দাম প্রায় ৫০ টাকা পর্যন্ত কমে আসবে। এতে রিজার্ভের উপর চাপ কমার পাশাপাশি সহজলভ্য হবে পাথর। এ ছাড়া পাথর ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ, গাড়ি কিস্তি দিতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
পাথর ব্যবসায়ী ও ক্রাশার মালিক শাব্বির আহমদ বলেন, এমনিতেই কোয়ারি বন্ধ থাকায় মিল চলছে না। আমদানি করা বোল্ডার পাথর ভেঙে কোনো রকমে তাদের চলছিল। এর মধ্যে কিছু আমদানিকারক বিদেশ থেকে ভাঙা পাথর আনছেন। এতে মিল মালিকরা পথে বসার উপক্রম।
সিলেট চেম্বারের পরিচালক ভোলাগঞ্জ পাথর আমদানিকারক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান মিন্টু জানান, বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।
সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, কোয়ারি ইজারা বা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সিলেটের ব্যবসায়ী মহল থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। ইজারাসংক্রান্ত নির্দেশনা এখনো তিনি পাননি। যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে নির্দেশনা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসএন
