শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়

‘ও রানী সালাম বারে বার, নামটি আমার জ্যোৎস্না বানু রানী থাকি লক্ষ্যার পাড়, মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি-বারি আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই, পথে ঘাটে লোক জমাইয়া মোরা সাপ খেলা দেখাই, ও মোদের সুখের সীমা নাই।’ এটি এক সময়কার বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবির গান। আর এই বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না ছবিটি ছিল বেদেদের জীবন নিয়ে নির্মিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসংকুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। এরা মূলত আমাদের দেশে বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী। কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজার সঙ্গে এরা ঢাকায় আসে। পরে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা, পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ থেকে উদ্ভূত। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ নিয়েই শত শত বছর ধরে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে আজও টিকে আছে ওরা। আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার ধার ধারে না ওরা। নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে বেদে সমাজের প্রচলিত ব্যবসাকেই ওরা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। শত কষ্টের মাঝেও এতেই যেন ওরা সুখ-শান্তি খুঁজে পায়।
বেদে সমাজের নারীরাই সংসারের মূল চালিকাশক্তি। নারীরা দূর-দূরান্তের গ্রামগঞ্জে গিয়ে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতে অভ্যস্ত। নারীরা রোগের জন্য মানুষের কাছে তাবিজ, কবচ, ওষুধ, কড়ি বিক্রি করে এবং মানুষকে যাদু ও সাপ খেলা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। আর পুরুষরা পাখি শিকার করে এবং সাপ ও মাছ ধরে অর্থ উপার্জন করে। এভাবেই বেদে সম্প্রদায় তাদের কষ্টে গাঁথা যাযাবর জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ‘দাঁতের পোকা ফালাই। কোমর ব্যথা, বাত ব্যথায় শিঙা লাগাই। যাদু দেখাই। সাপ খেলা দেখাই। খা-খা-খা বখখিলারে খা, কাঁচা ধইরা খা।’- প্রচলিত এ কথাগুলো নদীতে ভাসমান যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের। সুর ও ছন্দ মিশ্রিত এ কথাগুলো জানান দিচ্ছে বেদেদের উপস্থিতি। এদের আরেকটি অংশ সড়ক পথে এসে নদীর তীরে বাঁশের চেরা ও পলিথিনের সাহায্যে অস্থায়ী ছোট ছোট ডেরা বেঁধে খুপরি ঘরে ঘাঁটি গেড়ায় থাকতে দেখা যায়। রাতের বেলা কারো ঘরে সোলার বাতি আবার কারো ঘরে চার্জার লাইট ব্যবহার করে থাকে। এমনটি চোখে ধরা পড়ে বেদের সম্প্রদায়ের কষ্টে ভরা জীবনযাপন।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) বিকালে গাজীপুরের শ্রীপুরে তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের আমতলা এলাকায় কথা হয় বিক্রমপুর থেকে আসা বেদে সর্দার আক্তার মিয়া(৫০),সুমি( ৩০), শেফালী( ২৫)র সঙ্গে। এ সময় তাদের জীবনযাত্রার সম্পর্কে তারা জানান,তাদের একটা অংশ ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও বড় অংশ নৌকায় নদীতে ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে আসছে। কালের প্রভাবে বেদের জীবন বৈচিত্র্যে এসেছে নানা পরিবর্তন। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
তারা আরো জানান, নৌকায় নৌকায় বা বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী ভাবে ভ্রাম্যমাণ ঘর করে কিছু দিনের জন্য থাকা এই ভাবে ঘুরে ঘুরে জীবন অতিবাহিত করার কারণেই আমাদের যাযাবর বলা হয়। বৈচিত্রময় ও বর্ণিল জীবনের সবটুকু রং দিয়ে আমরা জীবন সাজাই।
তবে সমাজের মূলধারার জনগণের সঙ্গে তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি আলাদা হওয়ার কারণে তারা অনেকটাই পশ্চাৎপদ। আর এই পশ্চাতপদতার সূত্র ধরে তারা সাপ খেলা, তাবিজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা চুড়ি, ফিতা, বিভিন্ন শেকড়-বাকর বিক্রি ছাড়াও আদি ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির অনেক উপকরণও তারা বিক্রি করে থাকে। বেদেরা মাতৃতান্ত্রিক হলেও বর্তমানে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় খুব কষ্টের জীবন যাপন করছেন তারা।
কুসংস্কার ও উদাসীনতার কারণে বেদেরা শিক্ষার আলো ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত থাকায় শতাব্দীর পর শতাব্দী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম অন্ধকারেই পড়ে থাকে। ফলে সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ সময়েই ওরা স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। এমনকি অনেক সময় ওদের কেউ কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণও করে। শিক্ষার আলো না থাকায় বাইরের জগত থেকে ওরা আলাদা। বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহও ওদের নেই। ওরা দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে।
জানা গেছে, শীতের মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ১ মাস করে ৫-৬ মাস থাকে বেদেরা। বর্ষা মৌসুমে ওদের ব্যবসায় ভাটা পড়ে। সে কারণে জীবিকার উদ্দেশে ওরা আবার চলে যায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা বা উপজেলায়। বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই তাদের একটা অংশ নদীতে নৌকায় ভেসে কাটায় এবং আরেকটা অংশ ডাঙ্গায় খুঁপড়ি ঘর করে সেখানে বসবাস করে থাকে। তারা সরকারের কাছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য দাবি জানাচ্ছেন। তাহলে এই পেশা থেকে স্বাভাবিক পেশায় ফিরে আসবে বলে জানায় তারা।
এসআইএইচ
